পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
বুধবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪

সুলতানি বাংলার টাঁকশাল শহর

ছয়দফা নিউজ ডেস্ক:
ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান। ১৯৮৩ সাল থেকে কয়েক দফায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে উন্মোচিত হয়েছে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। মাত্র কয়েক বর্গকিলোমিটার জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে ৭০০ বছরেরও বেশি পুরোনো ১৫টিরও অধিক পুরাকীর্তি। নির্ণীত হয়েছে সুলতানি বাংলার টাঁকশাল শহর ‘মুহাম্মাদাবাদ’। এসব নিয়েই বিস্তারিত লিখেছেন– এসএএইচ ওয়ালিউল্লাহ ‘শহর মুহাম্মাদাবাদ’ সুলতানি বাংলার এক সমৃদ্ধ শহর। কে বা কাদের দ্বারা এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তা স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও এখানে প্রাপ্ত শিলালিপি, ইটলিপি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, সুলতানি আমলে শহরটির অবকাঠামোগত প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল।

শহরটির দক্ষিণ কোল ঘেঁষে বহমান ছিল সেকালের বিশাল ভৈরব নদ। শহরটিকে কেন্দ্র করে এই নদীতেই ছিল চারটির মতো পাকা নৌবন্দর। এসব নদীবন্দরের মাধ্যমেই তৎকালীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো শহর মুহাম্মাদাবাদের। অসংখ্য মসজিদ, মক্তব, পাঠাগার, পাকা কবরস্থান, সুপেয় পানির জোগান দিতে শহরের বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত দিঘিসহ নানাবিধ স্থাপনার সমন্বয়ে সুষমাময় করে গড়ে তোলা হয় শহরটিকে।

সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে এ অঞ্চলে আগমন ঘটে যোদ্ধা এবং পীর উলুগ খানজাহান আলীর। তিনি বাগেরহাটে পৌঁছানোর আগে মুহাম্মাদাবাদ শহরে অবস্থান করেন। তৈরি করেন বেশ কিছু মসজিদ এবং খনন করেন কিছু দিঘি।

শহর মুহাম্মাদাবাদ শনাক্তকরণ

১৯৯২-৯৩ সালে বারোবাজারের জোড়বাংলা মসজিদ খননকালে মসজিদসংলগ্ন দিঘির পাকা ঘাটের শেষ প্রান্তে ভগ্ন কিছু ইটলিপি পাওয়া যায়। যার অনুবাদ হচ্ছে ‘নবীজি বলেন, তার ওপর আল্লাহর আশীর্বাদ ও শান্তি বর্ষিত হোক। যিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করবেন।

মসজিদটি সুলতান হোসেন শাহের পুত্র সুলতান গিয়াসউদ্দিন আবুল মুজাফফর মাহমুদ শাহের শাসনকালে নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহ তার রাজ্য ও কর্তৃত্ব দীর্ঘজীবী করুন। এটির নির্মাতা হলেন সম্মানীয় ও শ্রদ্ধেয় জেনারেল মালিক মিহখান…বিনীত কামিনাহ ওয়াজির নবম বছর শহর মুহাম্মাদাবাদে এটি নির্মাণ করেছেন।’ এ ছাড়া আইন-ই-আকবরীতে লিখিত আছে- শেরশাহ মুহাম্মাদাবাদ জয় করেন। তখন হোসেন বংশীয় কেউ একজন যশোরের কাছে তার (শেরশাহের) গতি রোধ করেছিলেন। তবে তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কতগুলো হাতি ছেড়ে দিয়ে পালাতে বাধ্য হন। তা ছাড়া সাতগাছিয়া প্রত্ন ঢিবির এক কিলোমিটার পূর্বে কেনার উদ্দিনের বাড়ি থেকে উদ্ধারকৃত শিলালিপি (বর্তমান বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত) থেকেও জানা গেছে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের যুগে ৯২৩/৯২৫ (?) হিজরিতে বারোবাজার এলাকার পরিচিতি ছিল শহর মুহাম্মাদাবাদ।

টাঁকশাল শহর

বাংলার সুলতানি শাসকরা স্থানীয় মুদ্রা সরবরাহ ব্যবস্থা সহজ করার উদ্দেশ্যে টাঁকশালের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেন। রাজধানী ছাড়াও দেশের প্রশাসনিক এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাঁকশাল স্থাপন করে সেখান থেকে মুদ্রা জারি করতেন। মুদ্রার সাক্ষ্যে সুলতানি বাংলায় এখন পর্যন্ত ৪০টি টাঁকশাল শহরের নাম পাওয়া গেছে। মুহাম্মাদাবাদ টাঁকশাল শহর তারই একটি। মুহাম্মাদাবাদ টাঁকশালটি প্রথম মুদ্রা জারি করে ৮৫২ হিজরি সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের নামে। এবং সর্বশেষ এই টাঁকশালের মুদ্রা পাওয়া গেছে হোসেন শাহী বংশের শেষ সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের ৯৩৮ হিজরি সালের। এ ছাড়া এই টাঁকশাল থেকে সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, নাসির উদ্দিন নুসরত শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ, শামসুদ্দিন আবু নসর মুজাফফর শাহ প্রমুখ সুলতানগণ মুদ্রা জারি করেছেন।

মসজিদের নগরী

সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নে আমরা কমবেশি সবাই জেনেছি ঢাকাকে মসজিদের শহর বলা হয়। ঢাকা ‘মসজিদের শহর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে। মূলত মোগল আমল থেকেই মসজিদের নগরীতে পরিণত হয় শহরটি। পরবর্তী সময়ে ষোড়শ শতাব্দীতে খানজাহান আমলে নির্মিত ইসলামি স্থাপত্য রীতির মসজিদগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৮৫ সালে বাগেরহাটকে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেসকো।

মূলত মসজিদের আধিক্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই শহর দুটি এমন খ্যাতি পেয়েছে। তৎকালীন মুহাম্মাদাবাদ (বর্তমান বারোবাজার) শহরকেও অনায়াসেই ‘মসজিদের নগরী’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। কারণ মাত্র ৫-৬ বর্গকিলোমিটার জায়গায় খননের ফলে প্রায় ১৫টি মসজিদের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে, যার অধিকাংশই এখন নামাজ আদায় করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোড়ার মসজিদ। বারোবাজারে আবিষ্কৃত মসজিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অলংকৃত মসজিদ এটি। এর চারপাশের বাইরের দেয়ালেও রয়েছে পোড়ামাটির চমৎকার অলংকরণ।

এই শহরের সবচেয়ে ছোট মসজিদ শুকুর মল্লিক মসজিদ। ঐতিহাসিকদের মতে, এ মসজিদের নির্মাণশৈলীর সঙ্গে ঢাকার প্রথম নির্মিত মসজিদ ‘বিনত বিবির মসজিদ’র মিল রয়েছে। ১৯৭৮ সালে বিরাট আকারের একটি ঢিবি থেকে স্থানীয় জনগণ খননের মাধ্যমে সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদের কিছু অংশ আবিষ্কার করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননের মাধ্যমে ভেতরে ৪৮টি থামবিশিষ্ট বিশাল আকৃতির মসজিদটি পরিপূর্ণরূপে সবার সামনে উন্মোচিত হয়।

এটিই এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ মসজিদ। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন এটি খানজাহান আলী নির্মিত মসজিদ; কেননা এর নির্মাণশৈলীর সঙ্গে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের দারুণ মিল রয়েছে। বারোবাজারে আবিষ্কৃত মসজিদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ হচ্ছে মনোহর মসজিদ। এই মসজিদের ভেতরে বর্গাকৃতির ২৪টি থাম বা পিলার রয়েছে। আয়তনের হিসেবে এটিতে ৩৫টি গম্বুজ ছিল বলে অনুমান করা হয়।

জোড়বাংলা মসজিদ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইট দিয়ে তৈরি। এ মসজিদটি সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৫-৬ ফুট উঁচু মাটির বেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। বারোবাজারের অন্য কোনো মসজিদ এভাবে উঁচু বেদীর ওপর নির্মাণ করা হয়নি। মসজিদটির পাশে একটি মক্তব অথবা হুজরা খানা থাকার কারণে সম্ভবত মসজিদটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। এ মসজিদ খননের সময় প্রাপ্ত ইটলিপি থেকে জানা যায়, মসজিদটি সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের নিযুক্ত জনৈক উজির ৮০০ হিজরিতে নির্মাণ করেছিলেন।

এ ছাড়া এখানে খননের মাধ্যমে গলাকাটা মসজিদ, সওদাগরের মসজিদ, সাদিকপুর মসজিদ, কোটালী মসজিদ, সানাইদার মসজিদ, হাসিলবাগ মসজিদ, পাঠাগার মসজিদ, চেরাগদানী মসজিদ, পীর পুকুর মসজিদ ও নুনগোলা মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে।

দিঘির শহর

সমগ্র বারোবাজার এলাকায় প্রচুর দিঘি ও পুকুর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে; যেগুলো বহুকাল আগে খনন করা হয়েছে। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের মতে এ এলাকায় ১২৬টি দিঘি ও পুকুর রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে ৭১টি দিঘি বা পুকুর শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রানী মাতার দিঘি, সওদাগরের দিঘি, গলাকাটির দিঘি, চেরাগ দানি দিঘি, শ্রীরাম রাজার দিঘি, বেড় দিদি ইত্যাদি। তবে এই নগরে কেন এত বেশি দিঘি খনন করা হয়েছিল তার কোনো ঐতিহাসিক তথ্যাদি নেই।

বারোবাজারে প্রাপ্ত সুলতানি যুগের তরবারি ও হাতে লেখা কুরআন শরিফ

১৯৯৬ সালের ১২ এপ্রিল ‘সীমলা পুকুর’ খননকালে ছয় ফুট মাটির নিচ থেকে এ তরবারিটি পাওয়া যায়। যার দৈর্ঘ্য প্রায় চার ফুট ও প্রস্থ গড়ে তিন ইঞ্চি। আর হাতেলেখা কুরআন শরিফটি সাতগাছিয়ার কিনার উদ্দিন মোল্লার বাড়ি থেকে পাওয়া যায়। বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন দুটি গলাকাটি মসজিদে সংরক্ষিত রয়েছে।

অন্যান্য পুরাকীর্তি

এ ছাড়া এখানে রয়েছে নামাজ গাঁ কবরস্থান, বাদেডিহি প্রত্নস্থান, রাজকীয় কবরস্থান, গাজী-কালু-চম্পাবতীর মাজার, দমদম প্রত্নস্থান, জাহাজঘাটা (তৎকালীন পাকা নৌবন্দর) ইত্যাদি।

শহরটি ধ্বংসের সম্ভাব্য কারণ

বারোবাজার এলাকায় প্রাচীন কীর্তির ছড়াছড়ি দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, এই শহর সুলতানি বাংলায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভৈরব নদীতীরবর্তী পাকা বন্দর (স্থানীয়ভাবে জাহাজঘাটা নামে পরিচিত) প্রমাণ করে এই শহরের সঙ্গে তৎকালীন বাংলার রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা কতটা উন্নত ছিল। তবে বারোবাজারের বিভিন্ন স্থানে খননের ফলে প্রাপ্ত অগণিত মানুষের খণ্ড খণ্ড কঙ্কাল অনুমান করতে সহজ করে যে, একসময় এই শহরে অসংখ্য লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

এমনকি ১৯৯৪ সালে পীরপুকুর মসজিদ পরিষ্কারের সময় এটির ভেতর ও আশপাশে বিক্ষিপ্ত একাধিক নর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। মসজিদের মধ্যে এসব নরকঙ্কালের উপস্থিতি চিন্তাশীল মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে এখানে মুসল্লিদের হত্যা করে পরিকল্পিতভাবে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। কেননা বারোবাজার এলাকায় এতগুলো মসজিদ একসঙ্গে কীভাবে ঢিবিতে পরিণত হলো? সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মসজিদ বা ঢিবিগুলো খননের পূর্ব পর্যন্ত সমতল ভূমির ওপরেই ছিল। কোনো ধরনের মাটিতে দেবে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

এমনকি জোড়বাংলা মসজিদটি তো সমতল ভূমি থেকে ৫-৬ ফুট মাটির বেদীর ওপর এখনও টিকে আছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন, ভূমিকম্প বা বন্যার কারণে ধ্বংস হতে পারে। কিন্তু যুক্তির খাতিরে এই কথাও মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ বন্যা বা ভূমিকম্পের ফলে যদি প্রতিটি মসজিদ এভাবে মাটিচাপা পড়ে তাহলে অন্য স্থাপনাগুলোর অবস্থাও একই রকম হওয়ার কথা!

বিশেষত পুকুর বা দিঘিগুলো একই কারণে মাটির স্তূপে পরিণত না হলেও অন্তত ভরাট হয়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়ার কথা; কিন্তু তা হয়নি। এই কারণেই মনে করা হয় মসজিদগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এখান থেকেই ধারণা করা হয় কোনো স্থানীয় অমুসলিম শাসক বা জমিদার কর্তৃক ঐতিহ্যবাহী নগরী মুহাম্মাদাবাদের পতন ঘটে এবং মুসলমানদের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ভেঙে তারাই মাটিচাপা দেন। এভাবেই শহরটি মানবহীন জঙ্গলাকীর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়ে।

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ