পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪

বিশ্বজুড়ে ‘এল নিনো’র ভয়াবহ প্রভাব

সাধন সরকার
দেশজুড়ে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, বৃষ্টিপাত হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই তাপপ্রবাহ কমছে না। জলবায়ু বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, পৃথিবীজুড়ে ‘এল নিনো’র প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীব্যাপী যে সমস্যা বিরাজমান এল নিনো সেই সব সমস্যাকে আরও ত্বরান্বিত করে থাকে। এর সহজ অর্থ হলো, পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনোর সম্পর্ক রয়েছে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। এল নিনো সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। যা কয়েক বছর পরপর প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ। বাংলাদেশেও এল নিনোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

এল নিনো হলো আবহাওয়ার বিশেষ নেতিবাচক অবস্থা। এল নিনো বলতে মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ স্রোতকে বোঝায়। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্ব অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে এল নিনো বলে। এর ফলে অতি বেশি উষ্ণতা উপকূলীয় এলাকার ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ হারিয়ে গিয়ে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ চারদিকে বিরাজ করে। সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যা আঠারো মাসের বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। মূলত ইকুয়েডর, পেরু ও চিলির জেলেরা এই উষ্ণ স্রোতের সন্ধান পান। ধারণা করা হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের বাণিজ্যরত জাহাজগুলো উষ্ণ পানিকে দক্ষিণ আমেরিকার অংশ থেকে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া উপকূলে ঠেলে নিয়ে যেত। এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার অংশও এ সময় বিশেষ সুবিধা পেত! ফলে পেরু, ইকুয়েডর ও চিলি অংশে মৎস্যশিল্প ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। সময়ের পরিক্রমায় বাতাসের তাপ, চাপ ও গতিতে পরিবর্তন আসে। নিরক্ষরেখায় অবস্থান করা বায়ুপ্রবাহ উল্টো দিকে বইতে শুরু করে। এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া অংশের উষ্ণ পানি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু, ইকুয়েডর ও চিলি অংশে মৎস্যশিল্প ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। বর্তমানে এল নিনোর প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুম-লের ট্রপোম-লের আবহাওয়ায় চরম বিপর্যয় বয়ে নিয়ে এসেছে। এল নিনোর প্রভাবে নিম্নচাপ তৈরি হওয়ায় পেরু, ইকুয়েডর ও চিলি অংশসহ উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় (উত্তর আমেরিকাসহ) প্রচুর বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও উপকূলে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ফলে এশিয়া (বাংলাদেশ-ভারতসহ) ও অস্ট্রেলিয়ার বহু জায়গায় বৃষ্টিপাত কমে আসবে। দেখা দেবে শুষ্কতা। খরা ও দাবানলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। উল্লেখ্য, এল নিনোর বিপরীত অবস্থা হলো ‘লা নিনো’।

বৈশি^ক উষ্ণায়ন প্রসঙ্গে সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মন্তব্য করেছেন- বিশ্ব আর উষ্ণায়নের যুগে নেই, বিশ্ব এখন ফুটন্ত যুগে প্রবেশ করেছে। মার্কিন বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, এল নিনোর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে ২০২৪ সাল হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। ফলে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা (দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা) ছাড়িয়ে যেতে পারে! যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা ‘নোয়া’র (ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্টেশন) পূর্বাভাস অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়া-এশিয়াসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে এবার তাপমাত্রা বেশি উষ্ণ থাকবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাও (ঋঅঙ) একই রকম পূর্বাভাস দিয়েছে। লা নিনোর কারণে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কিন্তু এই অঞ্চলগুলোতে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। শুরু হয়েছে এল নিনোর প্রভাব। আবহাওয়ায় উষ্ণ স্রোতের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়ার পাশাপাশি কমে যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। এল নিনোর প্রভাবে ভারতীয় এলাকায় মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এল নিনোর প্রভাবে এশিয়ায় শুষ্কতা দেখা দেবে। আফ্রিকার
খরা পরিস্থিতিতে আরও ত্বরান্বিত করবে। একবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকটি এল নিনোর আবির্ভাব ঘটেছে বিশ্বে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে এল নিনো সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ওই বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড অতিক্রম করে। এ ছাড়া ১৯৯৭-৯৮ সালে এল নিনোর প্রভাবে সারা বিশে^ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ঝড় ও বন্যায় মারা যায় প্রায় ২৩ হাজার মানুষ।

জাতিসংঘের আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা- ‘ডব্লিউএমও’ তথ্য অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছর এ যাবৎকালের সবচেয়ে উষ্ণ সময় পার করতে পারে বিশ্ব। সংস্থার মতে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কমপক্ষে একটি বছর এবং সবমিলিয়ে এই পাঁচ বছর সময়কাল সবচেয়ে উষ্ণ হবে। সংস্থার গবেষণায় ২০২৩-২০২৭ সালের কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে। এল নিনোর প্রভাব যে শুরু হয়েছে তার সত্যতা দৃশ্যমান। চলতি বছর থেকে এশিয়ার দেশে দেশে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশে খাল-বিল-জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। চীনে প্রচ- দাবদাহে খাল-বিলের মাছ পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। ভিয়েতনাম ও লাওসে সাড়ে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে। সাধারণত ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে বিপজ্জনক বলে গণ্য করা হয়।

চলতি বছর কানাডার ভয়াবহ দাবানল বিশ্বকে ভয়াবহ বার্তা দিয়ে গেল! আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক দাবানল বিশ্বকে এল নিনোর ভয়াবহ জানিয়ে দিল! হিমালয়ের হিমবাহের দ্রুত গলন কী দুঃসংবাদ বয়ে আনছে তা অজানা! জলবায়ুর পরিবর্তনের এই বিসংবাদের মধ্যে আবার এল নিনোর ভয়াবহ প্রভাব জীবজগতের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী যদি তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে ফেলে তা হলে কী অবস্থা হবে এই পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহের? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি ব্যবস্থাপনা, খাদ্য নিরাপত্তা ও সর্বোপরি প্রকৃতি-পরিবেশের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে। উপর্যুপরি এল নিনোর প্রভাব এসব সমস্যাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

বাংলাদেশে আবহাওয়ার ওপর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এল নিনোর প্রভাব- কোনোটা থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাংলাদেশ। এবার শীত ও গ্রীষ্মকাল দুটোই শুষ্ক ছিল। ভারত থেকে মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করায় বর্ষাকালেও খুব বেশি বৃষ্টি হবে না তা এখন স্পষ্ট! চলতি বছর গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছেছিল। ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পাবনায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। বর্ষাকালেও যদি এল নিনোর কারণে শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না! কেননা বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে দাবদাহের ঘটনা ঘটেছে। তবে চলতি বছর মধ্য মে থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসের উষ্ণ সময় মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। বৃষ্টিপাত, ঝোড়ো হাওয়া হলে সাধারণত তাপমাত্রা কমে, কিন্তু এ বছর সেটাও দেখা যাচ্ছে না।

এল নিনোর প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল তথা দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। জলবায়ু সংকট থেকে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, সমাজ কোনোটাই বাদ পড়ছে না! এ অবস্থায় এল নিনোর ভয়াবহ প্রভাবসহ সব ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের কার্যক্রমকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অভিযোজন কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক পরিচিতি: সাধন সরকার, শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী, লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ

তথ্যসূত্রঃসময়ের আলো

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ