পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
বুধবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪

সফটশেল কাঁকড়াচাষ যেভাবে নতুন সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে সুন্দরবনের চাষিদের

ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবনসংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার সাধারণ মানুষকে জীবিকার জন্যে নির্ভর করতে হয় প্রকৃতির ওপর। তাদেরকে বেঁচে থাকতে হয় প্রকৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝে। সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলো প্রত্যন্ত বললেও কম বলা হবে। এ অঞ্চলের মানুষ বনে মধু সংগ্রহ থেকে শুরু করে নদীতে মাছ ধরে কোনোরকমে দিন চালান। পেটের ভাত জোগাড় করার সঙ্গে সঙ্গে বাঘের পেটে চলে যাওয়ার ভয় তো থাকেই, তার সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বনে ঢোকার নিষেধাজ্ঞা।

তবে বর্তমানে সফটশেল কাঁকড়া উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্যে বয়ে আনতে শুরু করেছে সৌভাগ্য। সুন্দরবনের মানুষ প্রাকৃতিক লোনা পানিতে নরম খোলসের কাঁকড়াচাষের দিকে ঝুঁকছেন। বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে সফটশেল কাঁকড়ার চাষ। আন্তর্জাতিক বাজারে সফটশেল কাঁকড়ার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিযোগ্য কাঁকড়া উৎপাদনে প্রতিবছর এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ খামার।

বাংলাদেশে মিঠা ও লবণাক্ত পানি মিলে প্রায় ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় শিলা কাঁকড়া। এ শিলা কাঁকড়া তার জীবদ্দশায় ১৪–১৬ বার খোলস বদলায়। খোলস বদলের সময় এ প্রজাতির কাঁকড়া তিনঘণ্টার বেশি সময় খোলসহীন অবস্থায় থাকে। ভেতরে নরম একটি আবরণ থাকে মাত্র। এ সময়টাতেই কাঁকড়াটি বিক্রির জন্য তুলে ফেলা হয়। এটিকেই বলা হয়ে থাকে সফটশেল বা নরম খোলসের কাঁকড়া। বাংলাদেশে যে কয়টি জেলায় সফটশেল কাঁকড়ার উৎপাদন হয় তার মধ্যে সাতক্ষীরা অন্যতম। মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখন কাঁকড়াচাষের সঙ্গে যুক্ত।

শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালি গ্রামের কাঁকড়াচাষি মোনতেজ সরদার আগে ধান চাষ করতেন। গত পাঁচবছর ধরে কাঁকড়াচাষ করছেন। স্থানীয় গণমুখী সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে বাগদা চিংড়ির ঘের ছেড়ে সেখানেই শুরু করেন কাঁকড়াচাষ। স্ত্রীর সঙ্গে মিলেই করেন কাঁকড়াচাষের যাবতীয় কাজ। কাঁকড়াকে মোটাতাজাকরণের জন্যে খাওয়াতে হয় তেলাপিয়া মাছ, শামুক, বাগদা চিংড়ির মাথা। প্লাস্টিকের বাক্সের মধ্যে করে শিলা কাঁকড়াগুলোকে উপযুক্ত ব্যবস্থায় চাষ করা হয়। তিনঘণ্টা পর পর বাক্স খুলে দেখতে হয় কাঁকড়া খোলস ছাড়ল কি না। ফলে সার্বক্ষণিক কাউকে না কাউকে থাকতে হয় বাক্সগুলোর দেখভালের জন্যে। পাঁচ সদস্যের পরিবারের সবাই পালাক্রমে কাঁকড়ার পরিচর্যার কাজ করেন বলে আলাদা করে লোক নিতে হয় না। কাঁকড়াচাষ করে বেশ ভালোভাবেই চলে যায় বলে জানালেন এ চাষি।

শ্যামনগর এলাকার কাঁকড়াচাষিরা তাদের সফটশেল কাঁকড়া বিক্রি করেন সেখানে বেসরকারি মালিকানায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন ফ্যাক্টরির কাছে। শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত ৬টি সফটশেল কাঁকড়ার ফ্যাক্টরি কাজ শুরু করেছে। এসব ফ্যাক্টরি থেকে কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা হয় বিভিন্ন দেশে।

আরেক কাঁকড়াচাষি মোহাম্মদ হাসেম আলী গতবছর সফটশেল কাঁকড়াচাষ করে লাভ করেছেন চার লাখ টাকা। তবে এ বছর লাভ তুলনামূলক কম। কাঁকড়ার দাম ওঠানামার কারণে মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়তে হয়। এ বছর ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন সফটশেল কাঁকড়া। কাঁকড়ার ফলন বর্ষার ভালো হয়। ‘বর্ষায় দিনে ৪০–৫০ কেজি সফটশেল কাঁকড়া তোলা যায়। তবে শীতে কাঁকড়ার ফলন কম,’ বলেন তিনি।

সুন্দরবনের জেলেরা শিলা কাঁকড়ার পোনা বা হার্ডক্র্যাব বুড়িগোয়ালিনী নদী থেকে এনে বিক্রি করেন স্থানীয় বাজারগুলোতে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া কাঁকড়ার পোনা ছাড়া কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার এই হার্ডক্র্যাবের দামও বেশ চড়া। সফটশেল কাঁকড়ার উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হার্ডক্র্যাবের চাহিদাও বাড়ছে। তবে সে তুলনায় বাড়ছে না হার্ডক্র্যাবের জোগান।

‘কাঁকড়াচাষের পর সেটি জমি থেকে তুলে বাইরের বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী আকারে কাটা হয়। এর আগে ক্লোরিন ও অক্সিজেন ব্যবহার করে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাঁকড়া পরিষ্কার করতে হয়। বেশ জটিল এ প্রক্রিয়াটির পুরোটাই হয় ফ্যাক্টরিতে। কাঁকড়া পরিষ্কার করে সাইজ অনুযায়ী কাটার পর সেটি একেবারে খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়। এরপর প্যাকেটজাত করে রাখা হয় ফ্রিজে,’ বলেন কাঁকড়াচাষি মামুন। যথাযথ পদ্ধতি জানলে ব্যক্তি উদ্যোগেও সফটশেল কাঁকড়া পরিষ্কার করা সম্ভব বলে জানান নিজস্ব উদ্যোগে ফ্যাক্টরির সাহায্য ছাড়াই কাঁকড়া চাষ থেকে প্যাকেটজাতকরণ পর্যন্ত সম্পন্ন করা এ উদ্যোক্তা।

শ্যামনগর উপজেলা মৎস্য অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, উপজেলায় সফটশেল কাঁকড়া চাষ হয় ১৮২ হেক্টর জমিতে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে কাঁকড়ার উৎপাদন হয়েছে এক হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন। উৎপাদিত সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি হয় জাপান, সিঙ্গাপুর, চীন, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।

দাতিনাখালি গ্রামের বাঘ-বিধবা ফাতেমা গাজীর স্বামী ২০১০ সালের মার্চে গোলপাতা সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়ে প্রাণ হারান। ফাতেমা চান না একমাত্র ছেলে বাপ-চাচার পেশাকে ধরে রাখতে সুন্দরবনে যাক। তাই ছেলেটি সফটশেল কাঁকড়াচাষিদের কাছে দৈনিকভিত্তিতে কাজ করে সংসার চালায় সংসার। এভাবে নরম খোলসের কাঁকড়াচাষের সুবাদে স্থানীয় অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে।

তবে শ্যামনগর এলাকার কয়েকজন কাঁকড়াচাষি জানালেন, সফটশেল কাঁকড়ার দেশীয় বাজার না থাকায় কাঁকড়ার দাম নিয়ে চাষিদেরকে স্থানীয় ফ্যাক্টরিগুলোর ওপরই ভরসা করতে হয়। লাভের পরিমাণ একেকসময় বেশ চড়া আবার কখনো বাজার পড়তে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে কাঁকড়া রপ্তানির হার আগের থেকে কমেছে বলেও জানান তারা।

মোনতেজ সর্দার বলেন, ‘ফ্যাক্টরিগুলোতেই কাঁকড়া একচেটিয়াভাবে বিক্রি করতে হয়। কারণ সফটশেল কাঁকড়ার দেশীয় বাজার নেই বললেই চলে। তাই দামের জন্যে নির্ভর করতে হয় ফ্যাক্টরির নির্ধারিত দামের ওপর।’ তার অভিযোগ, ফ্যাক্টরিগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে কাঁকড়ার দাম কমে যায়। কাঁকড়া খোলস ছাড়বার ৩০ মিনিটের মধ্যে বিক্রি না করলে মারা যায়। মারা গেলে সেই কাঁকড়া আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না।

অথচ চাইলেই কাঁকড়াচাষকে পুরোপুরি বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই অনেক চাষির। সফটশেল কাঁকড়াচাষের জন্যে চাষিদেরকে ৩৫ টাকা হারে প্রায় ৮–৯ লাখ টাকার প্লাস্টিকের বাক্স কিনতে হয়। এসব বাক্স পরে আর বিক্রি করার সুযোগ নেই। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এসব বাক্স কেনেন। কাঁকড়াচাষে তাদের অনীহা নেই। তবে এসব চাষির দাবি বিকল্প বাজার, যাতে তাদেরকে কাঁকড়া বিক্রির জন্য পুরোপুরি ফ্যাক্টরির ওপর ভরসা করতে না হয়।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, জেলাব্যাপী সফটশেল কাঁকড়ার উৎপাদন দুই হাজার মেট্রিক টনের কাছাকাছি। সিংহভাগ চাষই সুন্দরবন সংলগ্ন বুড়িগোয়ালিনী ও গাবুরা ইউনিয়নজুড়ে হয়। তবে কাঁকড়ার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ব্যাপারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সেভাবে নেই, যতটা রয়েছে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে।

খুলনা বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে শুধু খুলনা অঞ্চল থেকে ৬২২ মেট্রিক টন সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছে। এ খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৮৭ লাখ ডলার। ব্যক্তি উদ্যোগে সাতক্ষীরায় কাঁকড়াচাষ শুরু হয় বছর পাঁচেক আগে। ধীরে ধীরে কাঁকড়ার উৎপাদন বাড়ছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত আন্তজার্তিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা বেশি থাকে। কিন্তু সেই অনুপাতে উৎপাদন করা যাচ্ছে না জানিয়ে আনিছুর রহমান বলেন, ‘চাহিদা আর জোগানের মধ্যে একটা ফারাক থেকেই যাচ্ছে।’

গণমুখী ফাউন্ডেশন ও জাপান ফার্স্ট এইডের উদ্যোগে জেলায় একটি হ্যাচারি তৈরি করা হয়েছে বলে জানান আনিছুর রহমান। ‘কাঁকড়া চাষ, প্রক্রিয়াকরণ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং সরকারি সহযোগিতা বাড়লে কাঁকড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন নজির হয়ে দেখা দেবে। পাশাপাশি দেশের মানুষকে সুস্বাদু সফটশেল কাঁকড়ার সঙ্গে পরিচিত করে তোলা যেতে পারে,’ বলেন এ কর্মকর্তা।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সফটশেল কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে নেই কোনো উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। সুন্দরবনের চাষীরা তাদের বংশানুক্রমে পাওয়া জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সফটশেল কাঁকড়া চাষ চালিয়ে যাচ্ছেন জীবন-জীবিকার তাগিদে। কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নানাভাবে চাষীদেরকে সহযোগিতা করে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

লোনা পানির সফটশেল কাঁকড়ার রয়েছে উল্লেখযোগ্য রপ্তানি সম্ভাবনা। উপকূলীয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক লোনা পানিকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনা সম্ভব। কাঁকড়াচাষকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার সঙ্গে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ও প্রচারণা বৃদ্ধি এটিকে করে তুলতে পারে রপ্তানি খাতে এক নতুন বিপ্লব।

তথ্যসূত্রঃটিবিএস

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ