পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
রবিবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৪

এইসব মাচাং ঘর আর দেখা যাবে না!

উসিথোয়াই মারমা, বান্দরবান: মূল ঘরের লাগোয়া করে খোলা ও ছাদবিহীন অংশকে বলা হয় মাচাং ঘর। পাহাড়ের ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীই এ ধরনের ঘর তৈরি করে থাকে। ফলে বংশ পরম্পরায় এটি হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘর। বিশেষ করে গ্রামে বসবাসকারী জুমচাষিরা সেখানে কাপড় এবং ধান শুকায়। আর রাত হলে সেখানে বসে রূপকথার কাহিনি ও খোশ গল্পে মেতে ওঠে তারা।

বন জঙ্গলের হিংস্র বণ্যপ্রাণী থেকে বাঁচার জন্য একসময় পাহাড়ি মানুষদের বেছে নিতে হয়েছিল নানা কৌশল। বসতবাড়ি নির্মাণেও আত্মরক্ষার তাগিদে মাটি থেকে বেশ উঁচু করে বানাতে হতো ঘর। নিচে থাকত গাছ-বাঁশের অনেক খুঁটি। তিন পার্বত্য জেলার এলাকায় পাহাড়িদের কাছে এমন আদলে ঘরের নাম মাচাং ঘর।

মূল ঘরের লাগোয়া করে খোলা ও ছাদবিহীন অংশকে বলা হয় মাচাং ঘর। পাহাড়ের ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীই এ ধরনের ঘর তৈরি করে থাকে। ফলে বংশ পরম্পরায় এটি হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘর। বিশেষ করে গ্রামে বসবাসকারী জুমচাষিরা সেখানে কাপড় এবং ধান শুকায়। আর রাত হলে সেখানে বসে রূপকথার কাহিনি ও খোশ গল্পে মেতে ওঠে তারা।

machang3

স্থানীয়রা বলছেন, সেই মাচাং ঘর এখন বিলুপ্তির পথে। একদিকে বন উজাড়ের কারণে আগের মতো গাছ-বাঁশ পাওয়া যায় না, অন্যদিকে কিছু সচ্ছল ব্যক্তিও মাচাং ঘরের বদলে পাকা ঘরবাড়ি তৈরিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে অনেকের আশঙ্কা, একসময় দুর্গম এলাকা ছাড়া আর দেখতে পাওয়া যাবে না এই মাচাং ঘর।

বান্দরবান জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে চিমি ডলু পাড়া। দুই শতাধিক মারমা পরিবার রয়েছে এ পাড়ায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় অসংখ্য মাচাং ঘর। মাচাংয়ে কেউ কাপড় শুকায়। কেউ জড়ো করে রাখে খেত থেকে নিয়ে আসা নানা রকমের সবজি।

চিমি ডলু পাড়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব হ্লামেচিং মারমা মাচাং ঘরে বসে শীতে রোদ পোহাচ্ছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘বয়স হওয়ার সাথে সাথে মাচাং ঘরও বিলুপ্ত হচ্ছে। চোখের সামনে এখন পুরনো ঘর ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে ইট কংক্রিটের পাকার বাড়ি। নতুন প্রজন্মরা একসময় এরকম মাচাং ঘর দেখার সুযোগ পাবে না। ছোট থাকতে মাচাংয়ে বসে আমরাও রাজা-রানি ও রূপকথার গল্প শুনেছি। সারাদিন কাজ শেষে সেখানে পাটি বিছিয়ে পরিবারের সবাই কত গল্প করত। এমনই হতো গল্প শুনে শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম আমরা।’

একই পাড়ার বাসিন্দা মেহ্লাচিং মারমা এবং মংপু মারমা বলেন, বনে আগের মতো গাছ-বাঁশ পাওয়া যায় না। কিনতে গেলেও অনেক টাকা। এ কারণে বর্তমান ঘরটা ভেঙে দেওয়ার পর সামনে মাচাং অংশটা আর রাখব না। শুধু মূল ঘরটাই থাকবে।

তবে গাছ-বাঁশের সংকট থাকলেও অনেকে এখনো ঐতিহ্যবাহী ঘর হিসেবে মাচাং তৈরি করে রাখার ইচ্ছা পোষণ করেন। এমনই এক ব্যক্তি এই চিমি ডলু পাড়ার বাসিন্দা উচিংসা মারমা।

তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক, কিছুটা গাছ-বাঁশের সংকট রয়েছে। শুধু এ কারণে ঐতিহ্যবাহী একটা ঘর বানাব না সেটা হয় না। খরচ একটু বেশি হলেও দূর থেকে গাছ-বাঁশ সংগ্রহ করে মাচাং তৈরি করব। মাচাং ঘর নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে।’

দীর্ঘ সময় চট্টগ্রাম শহরে পড়াশুনা করা একই পাড়ার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট উছো অং মারমা বলেন, সারা বছর রোদে-বৃষ্টিতে থাকায় এই ঘরের স্থায়িত্ব কম। দুই থেকে তিন বছরের বেশি টিকে না এই মাচাং ঘর। ফলে বারবার খরচের কারণে নতুন করে বানাতে পারে না অনেকেই।

‘এ কারণে অনেকে তিন-চার বছর টাকা জমিয়ে মাটির ঘর অথবা পাকা বাড়ি তৈরি করে থাকে। মাচাং ঘর তৈরির করার দিকে ঝোঁকে না আর। ইট-পাথরের পাকা ঘর তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। সামর্থ্য থাকলেও সচ্ছল ব্যক্তিরা এখন মাচাং ঘর তৈরি করে না,’ বলেন তিনি।

এদিকে শহরে বালাঘাটা এলাকার বাসিন্দা সুফল চাকমা বলেন, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের মধ্যেও মাচাং ঘর তৈরির প্রবণতা অনেক কমে গেছে। শুধু দুর্গম এলাকা ছাড়া আর কোথাও মাচাং ঘর চোখে পড়ে না। স্থায়িত্বের কথা চিন্তা করে বেশিরভাগ মানুষ এখন সামর্থ্য অনুসারে মাটির ঘর অথবা পাকা ঘর তৈরি করে থাকে।

machang5

তবে বান্দরবান জেলায় ম্রো ও খুমী জনগোষ্ঠীর নব্বই ভাগ মানুষ এখনও মাচাং ঘর তৈরি করে থাকে জানিয়েছেন লেখক ও তরুণ গবেষক ইয়াঙান ম্রো বলেন, মাচাংয়ে ধান ও কাপড় শুকানো থেকে শুরু করে অনেক ধরনের কাজে লাগে। বাইরে থেকে মাছ-মাংস নিয়ে আসলে সেখানে বসে কাটা হয়। অতিথি কেউ ঘরে আসলে সেখানে হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়া ঘরে যাবতীয় খরচের পানি মাচাংয়ের এক কোণে অনেকগুলো লাউ খোলের পানির পাত্র রাখে।

এছাড়া ম্রো ও খুমী সমাজের বয়স্ক ব্যক্তিরা রাতে মাচাংয়ে বসে এখনও নাতি-নাতনিদের বিভিন্ন রূপকথার গুল্প শোনান। যুবক-যুবতীদেরও প্রেম-গল্প আড্ডার চল রয়েছে বলেন জানান তিনি।

machang6

পাহাড়ে এখন মাচাং ঘর দেখা যায় কেবল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে এই মাচাং ঘর এক সময় বিলুপ্তি হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন বলে মনে করেন বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটের পরিচালক মংনুচিং মারমা।

তিনি বলেন, ‘একসময় শহরে পর্যন্ত মাচাং ঘর থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে বিলুপ্ত হতে পারে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই ঘরকে ধরে রাখতে হলে ভিন্ন আদলে রক্ষা করতে হবে। এ কারণে অনেকেই এখন পাকা বাড়ি করার পরও ঘরের উঠানে অথবা লাগোয়া করে মাচাং ঘর তৈরি করে থাকে।’

তথ্যসূত্রঃটিবিএস

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ