সঞ্জু রায়, হায়দ্রাবাদ (ভারত) থেকে ফিরেঃ
ভারতের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার তালিকায় স্থান পাওয়া গোলকোন্ডা দুর্গ ভারতের হায়দ্রাবাদে অবস্থিত একটি প্রাচীন দুর্গ যা ছিলো কুতুবশাহী সম্রাজ্যের (১৫১২-১৬৮৭) রাজধানী। বিখ্যাত নুরজাহান হীরার আদিস্থান ছিলো এই দুর্গ তবে শুধু এক নূরজাহান হীরায় নয় বড় বড় আকারের পৃথিবী বিখ্যাত হীরার জন্যেই এই দুর্গের পরিচিতি সারাবিশ্বে। আজ এই দুর্গে হয়তো আর হীরা পাওয়া যায়না কিন্তু কয়েক কালের স্বাক্ষী ও দুর্গের সাথে জড়িয়ে থাকা বাদশা ও সুলতানদের নানা অজানা ইতিহাস আজও বছরজুড়ে দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক আসে এই গোলকোন্ডা দুর্গে।
সম্প্রতি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে অবস্থিত এই দুর্গ দেখতে বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্যদের নিয়ে আসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা উদ্দেশ্যে কিভাবে ভারত তাদের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রেখে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছে তা দেখানো আর ভারতের ইতিহাসকে সামনে থেকে দেখা। দুর্গের প্রবেশের সময়ই গাইড শেখ বাবার সাথে পরিচিত হয় যে কিনা গল্পের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শুরু করলেন দুর্গের ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানানোর কাজ। গাইডের মুখ থেকে জানা গেলো, কাকাটিয়া শাসনামলে এই দুর্গটি তৈরি হয়েছিলো কোন্ডাপাল্লি দুর্গের পশ্চিমভাগের রক্ষণভাগের জন্যে। রাজা কৃষ্ণদেব পাহাড়ের শীর্ষে এটি তৈরী করেন। তার উত্তরসূরী কন্যা রুদ্রমা দেবী এবং প্রপৌত্র প্রতাপরুদ্রের হাতে এর পুননির্মান এবং শক্তিশালীকরন হয়। দুর্গ এবং এর ভেতরকার শহর গ্রানাইট পাহাড়ের ওপর তৈরি হয়েছিলো যা উচ্চতায় ১২০ মিটার (৪৮০ ফিট)। ১৩৬৩ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী এটি বাহমানি শাসকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৪৯৫-১৪৯৬ সালের দিকে এটি জায়গীর হিসেবে দেয়া হয় কুলী কুতুব শাহকে। মুলত বাহমানি সালতানাতের অধীনে গোলকোন্ডা ধীরে ধীরে খ্যাতি লাভ করেছিল। বাহমানিরা মাটির দুর্গকে গ্রানাইট পাথর দিয়ে সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে। বাহমানিদের প্রতিনিধি হিসেবে গোলকোন্ডায় রাজ্যপাল সুলতান কুলী কুতুব-উল-মুলক (১৪৮৭-১৫৪৩) শহরটিকে তাঁর সরকারের কেন্দ্র হিসাবে ১৫০১-এর দিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৫৩৮ সালে স্থানটিতে কুতুব শাহী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬২ বছর ধরে মাটির কেল্লাটি প্রথম তিনজন কুতুব শাহী সুলতানদের দ্বারা বর্তমান কাঠামোতে প্রসারিত হয়েছিল, যা গ্রানাইটের এক বিশাল দুর্গ হিসেবে হিসাবে প্রায় ৪ কিলোমিটার (৩.১ মাইল) পরিধি নিয়ে বিস্তৃত ছিল। হায়দরাবাদে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরে ১৫৯০ অবধি এটি কুতুব শাহী রাজবংশের রাজধানী ছিল। দুর্গটি ১৬৮৭ সালে পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয় এবং যখন মুঘল শাসক আওরঙ্গজেব হায়দ্রাবাদ দখল করেন তখন দুর্গটি মুঘল অধীনে চলে আসে।
ঐহিত্যবাহী এই দুর্গে প্রবেশের সময় চোখে পরে সুবিশাল ও কারুকার্য করা দৃষ্টিনন্দন প্রবেশ ফটকের। দুর্গটিতে প্রবেশের জন্যে রয়েছে আটটি গেট এবং চারটি স্থানান্তরযোগ্য ব্রিজ। পূর্বদিকের বালা হিসার গেট হচ্ছে প্রধান প্রবেশপথ। ভিতরে আছে রাজকীয় আবাসন এবং দরবার হল, মন্দির, মসজিদ, অস্ত্রাগার ইত্যাদি। একদম নিচে আছে সর্ববহিস্থ দেয়াল যা দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত ফাতেহ দরজা দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। ফাতেহ দরজা অর্থ বিজয়ের দরজা। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী বিজয়ীর বেশে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলো। বড় লোহার স্পাইক দ্বারা গেট অলংকৃত। কথিত আছে যে দরবার হল থেকে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি প্রাসাদ পর্যন্ত গোপন সুড়ঙ্গ বিদ্যমান। চারমিনারের দিকেও একটি সুড়ংগ আছে বলে জানান গাইড শেখ বাবা। গোলকোন্ডা দুর্গ কমপ্লেক্স আসলে চারটি দুর্গের সমস্টি যা চতুর্দিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পেরিসিমার দেয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশ ফটক পেরিয়ে ভিতরে যেতেই দেখা মেলে এক তেলেসমাতি কান্ডের। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরেন গাইড শেখ বাবা। দু-হাতে করজোড়ে তালি দিলে উপরের মহল থেকে সাথে সাথে ফিরে আসে প্রতিধ্বনি যে কৌশল সেসময় ব্যবহার করা হতো শত্রুপক্ষের আনাগোনা মহল পর্যন্ত সিপাহীদের কানে পৌঁছাতে। অনেকটায় ধ্বংস হয়েছে দুর্গের মূল স্থাপনাগুলো তবুও যে সৌন্দর্য্য ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হয়ে দুর্গটি দাঁড়িয়ে আছে তা যেকোন পর্যটকের চোখ আটকাতে বাধ্য করবে। ভিতরে গিয়ে দেখা মেলে তিনটি মনোমুগ্ধকর কারুকার্য করা মসজিদের যথাক্রমে তারামতি মসজিদ, ইব্রাহীম মসজিদ এবং হীরাখানা মসজিদ। কুতুবশাহী সুলতানের রওজাও আছে এখানে। দুর্গের বাহিরের দিকে দুটো আলাদা প্যাভিলিয়ন দর্শনার্থীদের মনেযোগ আকর্ষণ করে একবারের জন্যে হলেও। এছাড়াও দেখা গেলো আশলাহ খানা, বন্দিশালা, হাবশি কামান, উটের আস্তাবল, নাগিনা বাগ, আম্বরখানা ইত্যাদি। এই দূর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় রয়েছে মহাকালী ও জগদম্বা মন্দির যা হায়েদ্রাবাদের প্রথম মন্দির হিসেবে মনে করা হয়।
বিভিন্ন বিন্যাস এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ঠান্ডা বিশুদ্ধ বাতাস দুর্গের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়। ভাবতেও ভাল লাগছিলো যে স্থান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সকলে তা একসময় সুলতানদের নিবাস ও শাসন ছিলো। সবচেয়ে অবাক হয়েছি উঁচু এই দুর্গে পানি তোলার প্রক্রিয়ার কথা জানতে পেরে। জানা যায়, ২০-২৫ জন লোক সেই আমলে ৪৮০ ফুট দূর থেকে চরকা ঘুরিয়ে সুউচ্চ এই দূর্গে তুলতো পানীয় জল। সেসময় প্রযুক্তি ছিলোনা কিন্তু ছিলো তাদের মেধা ও শ্রম যা আজও ভাবায় সকলকে।
দূর্গে বেড়াতে এসেছিলেন দিল্লী থেকে উমেশ যাদব যার সাথে কথা বললে তিনি জানান, নিজ দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করে দিতে নিজ সন্তানদের নিয়ে এসেছেন তিনি। অনেক স্বপ্ন ছিলো কোহিনুর হীরার দুর্গের সাথে নিজে এবং সন্তানদের পরিচয় করিয়ে দিবেন তাই এতদূর এসেছেন। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত খুশি তিনি।
দূর্গের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন প্রায় দেশী-বিদেশী ৩০-৪০ হাজার পর্যটক বেড়াতে আসেন তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়েদ্রাবাদের বহু প্রাচীন এই দূর্গে।
দুর্গে থাকা উপরে উঠার সিঁড়িগুলো কষ্ট করে জয় করতে পারলেই সুযোগ মিলবে পাখির চোখে হায়দ্রাবাদ দেখার। বিশুদ্ধ বাতাস ও দেশ বিদেশের পর্যটকের সাথে কুতুব শাহী সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ্ শিখড়ে উঠে কল্পনাতে সে আমলে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মন্দ হয়না। দক্ষিণ ভারতে যে কয়টি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আছে তার মাঝে গোলকোন্ডা অত্যন্ত জনপ্রিয় তাইতো শুধু ভারত নয় স্থানটি পর্যটক আনছে সারাবিশ্ব থেকেই।