ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতকে টাইব্রেকারে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। এই অর্জন সম্ভব হয়েছে গোলরক্ষক ইয়ারজানের দারুণ দক্ষতায়। টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষকের ট্রফিটাও নিজের করে নিয়েছেন তিনি। ইয়ারজানের এই সাফল্যে উচ্ছ্বাস বইছে তার গ্রামে। হয়েছে মিষ্টি বিতরণও।
ইয়ারজান বেগমের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। তিনি সেখানকার আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে।
আজ সোমবার (১১ মার্চ) সকাল থেকে ইয়ারজানদের বাড়িতে নানাবয়সি মানুষের ভির শুরু হয়। এসময় ভিডিও কলের মাধ্যমে বাবা-মাসহ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন ইয়ারজান। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ের এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত এলাকাবাসী। আনন্দিত পরিবার এবং প্রতিবেশিরাও। এসব মানুষের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেন স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক এটিএম আখতারুজ্জামান ডাবলু।
এটিএম আখতারুজ্জামান ডাবলু বলেন, ‘ইয়ারজান আমাদের এলাকার কৃতিসন্তান। তার পরিবার একবারেই হত-দরিদ্র। তার মা রেনু বেগমের আয়েই চলে তাদের সংসার। এমন পরিবার থেকে ওঠে আসা সহজ বিষয় নয়। ইয়ারজানের সাফল্যে আমরা গর্বিত। আমরা প্রত্যাশা করছি সামনে জাতীয় দলেও জায়গায় করে নিবে এবং বাংলাদেশের ফুটবলকে ভালো কিছু উপহার দিবে। ইয়ারজানে জন্য শুভকামনা রইলো।’
জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রামে ইয়ারজানদের বাড়ি। সড়কের পাশেই ছোট ছোট দুইটি ঘর তাদের। এর মধ্যে একটি ঘর একেবারেই জরাজীর্ণ। একপাশে ছাউনির টিনগুলো খুলে গেছে। সেই ঘরের শোকেজে সাজানো আছে ইয়ারজানের সাফল্যের ক্রেস্ট এবং ট্রফি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক শারীরিকভাবে অসুস্থ। কোন কাজ করতে পারেন না। ফলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মা রেনু বেগমই। রেনু বেগমের উপার্জনেই চলে তাদের সংসার। সম্পদ বলতে তাদের কেবল ভিটেমাটি।
মেয়ের সাফল্যে আপ্লুত রেনু বেগম। তিনি বলেন, ‘খুব কষ্ট করে আমার মেয়ে এই পর্যন্ত এসেছে। মানুষের কৃষি জমিতে কাজ করে মেয়েকে বড় করেছি। অভাবের সংসারে মেয়েকে তিনবেলা ঠিকমত খাওয়াতে পারিনি। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে, আমাদের গর্বিত করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরি পাই। এ দিয়েই অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা খরচ এবং সংসার চালাই। অনেক সময়ে মেয়েকে অনুশীলনে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া দিতে পারতামনা। কিছু কিনে খাবে এজন্য অতিরিক্ত টাকা কখনই দিতে পারিনি। আজকে সব কষ্ট আমার দূর হয়েছে, গর্বে বুক ভরে গেছে।’
ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহ মেয়ের। তবে আমরা কখনো উৎসাহ দেইনি, মানুষও ভালো বলতোনা। তাছাড়া অনুশীলনে পাঠানোর মত ব্যবস্থাও ছিল না। কিন্তু মেয়ে এসবে তোয়াক্কা করতোনা। তাই সংসারে টানাপোড়ন উপেক্ষা করেই তাকে সাপোর্ট দিয়েছি। সবচেয়ে বেশি অবদান তার মায়ের। টুকু ফুটবল একাডেমিও অনেক সহযোগিতা করেছে। এখন আমার মেয়ে সেরা গোলরক্ষক। আজকে মেয়ের সাফল্যে গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। বাড়িতে এত মানুষ দেখে খুব ভালো লাগছে আমার। আমি চাই আমার মেয়ে ভালো কিছু করুক। আমাদের নাম উজ্জল করুক।’
ইয়ারজান হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আফসার আলী বলেন, ‘ইয়ারজান স্কুলের একজন আন্তরিক ও পরিশ্রমী ছাত্রী। খেলাধুলায় ইতোপূর্বে স্কুলের বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে খেলা ফাইনাল ম্যাচের পুরোটাই আমি টিভিতে দেখেছি। তার দুর্দান্ত কিপিং আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার ধারাবাহিক সাফল্যে আমরা গর্বিত।’
ইয়ারজান অনুশীলন করতো পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমিতে। একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, ‘সম্ভাবনাময়ী খেলোয়াড়দের আমি প্র্যাকটিস করাই। ইয়ারজান অত্যান্ত পরিশ্রমী ছিল। বরাবরই সে সেরাটাই উপহার দিয়ে এসেছে। সর্বশেষ নেপালের মাঠে ইয়ারজান যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের। আমি আশা করছি ইয়ারজান ফুটবলকে ভালো কিছু উপহার দিবে।’