ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা না পেয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা বিএনপির মারাত্মক ভুল বলে মনে করেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া বিএনপির আরেকটি বড় ভুল। কোনো রাজনৈতিক দল এক দশকের মধ্যে দুটি নির্বাচন বয়কট করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি, এবারের নির্বাচন বয়কটও বিএনপির অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি করতে পারে মনে করেন জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক।
ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারে ‘বিএনপি কি তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশার সম্মান রাখছে’ প্রকাশিত প্রবন্ধে মাহফুজ আনাম লিখেছেন, এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সেটাই প্রকাশ পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামেনি। গত বছর বিশাল জনসমর্থনের বীজ বপন করতে পারলেও এ বছর সেখান থেকে সাফল্যের কোনো ফসল ঘরে তুলতে পারেনি । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি জানানো হলে এর প্রতিক্রিয়া যে কঠোর কিছু হবে, তা অবধারিতই ছিল। কিন্তু কঠোর পরিস্থিতি এলে কীভাবে টিকে থাকা যাবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
মাহফুজ আনাম বলেন, ‘যদি বিএনপির উদ্দেশ্য এটাই হয়ে থাকে যে তারা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রভাব কমাবে, তাহলে নির্বাচনের সময় ক্ষমতা ভাগের প্রস্তাব দিতে পারত। সেক্ষেত্রে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে সরকারের কিছু পদ বিরোধী দল বা নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিতে পারত। যেহেতু নির্বাচনে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেক্ষেত্রে এই বাহিনীর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ কমাতে বিশেষ কিছু প্রস্তাব দেওয়া যেত। এ ধরনের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হলে তা ভোটারদের এই বার্তা দিত যে, বিএনপি তাদের দাবিতে অনড়, কিন্তু তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার আগ্রহ রয়েছে।’
মাহফুজ আনাম লেখেন, ‘সব বিকল্প আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া বিএনপির আরেকটি বড় ভুল। বিএনপি যে ‘বাইরের চাপ’র ভরসায় ছিল, সেখান থেকেও তারা পুরোপুরি হতাশ হয়েছে। বিএনপি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যখনই আলোচনায় বসেছে, তাদের কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেননি। বরং সবাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির কানে এই বার্তা পৌঁছায়নি।’
ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক আরও বলেন, ‘তর্কের খাতিরে যদি বলাও হয়, যে আওয়ামী লীগ কখনোই চায়নি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তাহলে একথাও বলতে হবে বিএনপিও কখনোই টের পায়নি যে তাদের এই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত, সরকারকেই সহায়তা করছে।’
লেখায় মাহফুজ আনাম পরিস্কার লেখেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ফল কী হয়েছিল, সেটা সম্ভবত পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করেনি বিএনপি। তারা যদি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন না করত, তাহলে খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তার অবস্থান হারাতেন না। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারলেও, সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারত। বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াও তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়ার মামলাগুলো লড়তে বাড়তি সুবিধা পেতেন। এবার ধরে বিএনপির দ্বিতীয় বারের মত নির্বাচন বয়কট করলো। এই অঞ্চলে তো বটেই, সম্ভবত কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই কোনো রাজনৈতিক দল এক দশকের মধ্যে দুটি নির্বাচন বয়কট করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি।’
বিএনপির নির্বাচনী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মাহফুজ আনাম লেখায় মন্তব্য করেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে যে, বিএনপি মনে করে, নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা না পেলে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো কারণই নেই। এমন চিন্তা একটি মারাত্মক ভুল। শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকার প্রয়োজনগুলো তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। বিএনপি এটা বিবেচনা করলো না যে তাদের নিজস্ব নীতি ও ভিশন প্রচারে শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে সংসদ এবং আগামীতে তারা সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারতো।’
তিনি লিখেন, ‘বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে তাদের একক বা জোটগত ৩০০ মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী দেশের আনাচে-কানাচে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে পারতেন এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহার, অপকর্ম ও দুর্নীতির চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। এই প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দল খানিকটা হলেও জবাবদিহির আওতায় আসত এবং বিএনপির প্রতি জনগণের সমর্থন জোরালো হতো। আর কিছু না হলেও বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণার কারণে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা হলেও সংযত হতো। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও আসার আগ্রহ পেতেন, যা নিঃসন্দেহে আমাদের নির্বাচনের মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত। আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের অংশগ্রহণে গ্রাম পর্যায়েও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বিএনপির সমর্থকরা সেগুলো কেবল দেখছেন, তাদের করার আর কিছুই নেই।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহফুজ আনাম স্বীকার করেন যে বিএনপি শুধু হরতাল ও অবরোধের ডাক দিচ্ছে, যা কেউ মানছে না। গণবিক্ষোভের ডাক দিচ্ছে, যা কেবলই ফাঁকা বুলি। তিনি বলেন, ‘কী এক নিদারুণ করুণ দশায় রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি।’