ছয় দফা নিউজ ডেস্ক:
বহু বছর আগের কথা। বাংলাদেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। ওই সময় ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মার্লো ঢাকায় আসেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের পর মার্লো বলেছিলেন, ‘তাঁকে আর শুধু একজন সাধারণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ভাবা যায় না। তাঁকে দেখা যায় বাংলার প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, বৃক্ষরাজি, শস্যক্ষেত্রের মাঝে।’
বঙ্গবন্ধু কি আসলেই একজন মানুষ, নাকি মহামানব, প্রশ্ন রেখেছিলেন বিদেশি এক সাংবাদিক। কারণ বঙ্গবন্ধুর দেহের গড়ন থেকে শুরু করে কথা বলার ধরন, সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনায় মনে হয়েছিল তিনি কোনো মহামানব। যে মহামানব শুধু মানুষেরই জন্য।
কবি সুকান্তের কবিতার একটি পঙ্ক্তি, ‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাতে/ তাঁর মুখে খবর পেলাম…।’ খবরটি শুধু জন্মদাতা শেখ লুৎফর রহমান কিংবা মা সায়রা বেগম পাননি। পেয়েছে আকাশ-বাতাস থেকে শুরু করে সারাবিশ্ব। সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল কি না অনেকের মনে নেই। মনে নেই জোছনায় ভেসে গিয়েছিল কি না এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। শুধু মনে আছে, রাতটি ছিল মঙ্গলবার। আজ থেকে শতবর্ষেরও আগে সেই রাতে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি।
মাতৃগর্ভ থেকে জন্মলাভের পর নবজাতক সারাবিশ্বকে জানান দেন, তিনি শেখ মুজিব। কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের গানের একটি কলি হচ্ছে-‘ছোট একটি গ্রাম, টুঙ্গিপাড়া যার নাম/ সেই গাঁয়ের একটি ছেলে হাসত খেলত বেড়াত, আর স্বপ্ন দেখে যেত’। সেই চোখজুড়ানো প্রাণ ভরানো গ্রামে বঙ্গবন্ধুর জন্ম। বলা যায়, আবির্ভাব হয় বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রদূতের।
বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি বলেছেন, ‘আমার জন্ম ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে।’ তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি দুষ্টপ্রকৃতির ছিলাম। আমি খেলাধুলা করতাম।’ ফুটবল থেকে শুরু করে অনেক খেলাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয়।
বঙ্গবন্ধু যে দিন জন্ম নেন সেদিন ছিল মঙ্গলবার। মঙ্গলবার নিয়ে গণকদের অনেক কথা শোনা যায়। বিশেষ করে এদিনে যারা জন্ম নেন তাদের চরিত্রে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এ লগ্নের জাতকরা একটু জেদি হয়। একরোখা হয়। এদের মনের জোর বেশি। এরা যা চায় তা বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত সুস্থির হয় না। আশ্চর্যের বিষয়, বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এসব লক্ষণ ছিল। আর তা একেবারে ছোটবেলা থেকে।
জানা গেছে, গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের ডাকসাইটে হেড মাস্টার ছিলেন গিরিশ বাবু। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ছোট বেলা থেকেই ডানপিঠে আর একরোখা গোছের ছিলেন। কিশোর মুজিবের সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতা মুগ্ধ করেছিল।
এ কথা ভাবতে অবাক লাগে-বঙ্গবন্ধু মাত্র ১১ বছর বয়সে গ্রেফতার হন। কারণ তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। আর মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম কারাবন্দি হন। তাঁর কারাবাসের অন্যতম কারণ ছিল তিনি রাজনীতি করতেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘আমার যেদিন প্রথম জেল হয় সেদিনই আমার নাবালকত্ব ঘুচেছে বোধ হয়।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বদেশ সমাজ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই যিনি আমাদের সব সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশি সমাজকে ভক্তি করিব। সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির যোগ রক্ষিত হইবে’ (পৃষ্ঠা-৬৩৫)। কবিগুরুর বাণীর পরিস্ফূটন ঘটেছিল বাংলাদেশে। আমরা পেয়েছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
আজ ১৭ মার্চ বাঙালির সেই অবিসংবাদিত নেতা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৫তম জন্মদিন।
মা-বাবা ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। ধীরে ধীরে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। তাঁর হাত ধরেই আসে বাঙালির স্বাধীনতা। জন্ম নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু মাত্র ৫৫ বছর বয়সে হায়েনার দল কেড়ে নেয় তাঁর প্রাণ। ঘাতকরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক বেশি তেজস্বী। চিরদিন তিনি বাংলাদেশের পথপ্রদর্শক হয়ে সূর্যের মতো মাথার ওপর জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন।