ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মালয় রাজনীতির জায়ান্ট এবং দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী, মালয় ম্যান্ডেলা খ্যাত আনোয়ার ইব্রাহিমের একসময়ের রাজনৈতিক গুরু, মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে এই প্রথম তদন্ত শুরু করেছে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি)।
মাহাথির মোহাম্মদের ছেলে ও পেজুয়াং প্রেসিডেন্ট, মুখরিজ মাহাথির নিশ্চিত করেছেন যে, মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি) তার বাবা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
মালয় ডেইলির এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, আমি আমার দুই ভাই মিরজান এবং মোখজানি দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কমিশনার, আজম বাকী স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ দেখেছি। যাতে বলা হয়েছে যে তুন মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। আমাদের দুই ভাইকে তদন্তে সহায়তা করার জন্য আমাদের সম্পদের পরিমাণ ডিক্লেয়ার করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
মাহাথির মোহাম্মদের ছেলে আরো বলছিলেন, আমরা এটা অদ্ভূত মনে করি যে, একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এভাবে তদন্তে ক্ষমতার অপব্যবহারের সন্দেহ করতে পারি – এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই কারণ আমাদের বিস্তারিতভাবে কিছু বলা হয়নি – যাদের তদন্ত করা হচ্ছে আমরাও তার সন্তান।
এদিকে ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে জানিয়েছে, গত ২৩ শে মার্চ ২০২৪, মাহাথিরের দুই বড় ছেলে বলেছিলেন যে, মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি) কে তাদের পিতার তদন্তে সহায়তা করার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া প্রথমবারের মতো ৯৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে টার্গেট করা হয়েছে মাসব্যাপী তদন্ত করার জন্য।
ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে আরো জানিয়েছে, ব্লুমবার্গের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে ৬৩ বছর বয়সী মোখজানি বলেন, আমার বাবা প্রাথমিক ভাবে সন্দেহভাজন। তারা যে আমার বাবার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে আমরা তার সাক্ষী।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে, মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি) ৬৩ বছর বয়সী মোখজানি এবং ৬৫ বছর বয়সী মিরজানকে ১৯৮১ সালে, যে বছর মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হন, সে বছরের তাদের সম্পদ ডিক্লেয়ার করার নির্দেশ দিয়েছে।
উল্লেখ্যে যে, তুন ডঃ মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মোট ২২ বছর এবং পরে ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ২ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দু’বারে সর্বমোট ২৪ বছর মালয়েশিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এবং এখন পর্যন্ত তিনিই দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে দেশটির ক্ষমতার মসনদের ইতিহাস বলছে, একুশ বছর বয়সে ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন নামে একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন মাহাথির মোহাম্মদ, যেটির সংক্ষিপ্ত রূপ ইউএমএনও। দলটি আমনো নামে বেশি পরিচিত। সে সময় ডাক্তারি পেশায় ছিলেন তিনি। রাজনীতির পাশাপাশি নিজের এলাকায় সাত বছর ধরে ডাক্তারি পেশার চর্চা করেন তিনি।
১৯৬৪ সালে তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হন। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুল রহমানকে আক্রমণ করে খোলা একটি চিঠি লেখায় এবং তিনি ‘মালয় ডিলেমা’ নামে একটি বির্তকিত বই লেখায় ১৯৬৯ সালে তিনি তার আসন হারান এবং তাকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়।
মালয় ডিলেমা’ নামে বির্তকিত বইয়ে তিনি দাবি করেন, দেশটিতে মালয় জাতি আসলে কোণঠাসা এবং তিনি তাদের এই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক অধিকার অবলীলায় মেনে নেয়ার জন্য সমালোচনা করেন।
ফলে তার এই মত ইউএমএনও’র দলের ভেতরে থাকা তরুণ নেতাদের প্রভাবিত করে এবং তারা তাকে আবার দলে ডেকে পাঠায়।
ফলে, ১৯৭৪ সালে তিনি আবারো পার্লামেন্ট সদস্য হন এবং সে বছরই তাকে শিক্ষামন্ত্রী করা হয়। এরপর মাত্র চার বছরে তিনি ইউএমএনও’র দলের উপনেতা হন এবং ১৯৮১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।
বলা হয়, তার শাসনামলে মালয়েশিয়া ১৯৯০’র দশকে এশিয়ান অর্থনৈতিক টাইগার দেশের তালিকায় উঠে আসে যার বর্তমান রূপ আধুনিক স্থাপত্যশৈলির দেশ মালয়েশিয়া। তাছাড়া তার বাস্তবমুখী উন্নয়ন নীতির কারণে মালয়েশিয়ার ঘরে ঘরে তার জনপ্রিয়তা বাড়লেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কিছু অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
দেশটির রাজনীতির চিত্র বলছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ইউএমএনও’র সদস্য থাকাকালীন সময়ে ১৯৯৩-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৯১-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তারই রাজনৈতিক গুরু, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কর্তৃক বরখাস্ত হন তিনি। এবং আনোয়ার ইব্রাহিম দুর্নীতি ও সমকামিতার দায়ে জেলহাজতে প্রেরিত হলে মাহাথির ও আনোয়ারের মধ্যে গড়ে ওঠে সাপে নেউলে।
যদিও সে সময় থেকে আনোয়ার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সব সময়ই দাবি করেছেন, রাজনীতিতে তাকে পথের কাঁটা হিসেবে দেখতেন মাহাথির মোহাম্মদ। এ জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাতে চেয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৮ সালেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল আনোয়ার ইব্রাহিমের। কিন্তু একসময়ের রাজনৈতিক গুরু আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের কোপানলে পড়ে জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে তাকে। ২০২০ সালে আনোয়ারের সাথে জোট করে মাহাথির ক্ষমতায় এলেও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেননি মালয় ম্যান্ডেলা আনোয়ার ইব্রাহিমের।
ফলে, দীর্ঘকাল জেলের চার দেয়ালের বাসিন্দা সেই আনোয়ার ইব্রাহিমই যে সময়ের আবর্তে মাহাথিরের দীর্ঘ ২৪ বছরের মসনদে। তবে কি, এবার দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে জেল খাটানোর দায়ে প্রতিশোধের পালা? নাকি ৯৮ বছর বয়সী এশিয়ার লিজেন্ড দেখাবেন তার শেষ খেলা?