ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: চিনি, পেঁয়াজ, চাল ও গমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশের জন্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
নিজ দপ্তরে দায়িত্বগ্রহণের প্রথম দিনে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসান ইসলাম টিটু বলেন, ”প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন। ভারত পেঁয়াজসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্য রপ্তানির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য শিথিল করবে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে এ বার্তা দিয়েছেন।”
রোববার সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, শনিবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় অনুষ্ঠিত অনানুষ্ঠানিক মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
টানা চতুর্থবারের মতোন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় এর আগে গত ৮ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফোনালাপে তাঁদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানান বিষয়ে আলোচনা হয়।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ভারত থেকে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়। অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমি নিজেও ভারত সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করব। বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ভারত থেকে নিয়মিতভাবে আমদানি যাতে সচল থাকে, সে বিষয়ে কথা বলবো।”
বাংলাদেশ চাল, গম, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ এসব পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি করে ভারত থেকে। বিভিন্ন সময় ভারত এসব পণ্যের কোনো কোনটির রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে– তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের বাজারে এগুলোর দাম অনেক বেড়ে যায়।
তাই দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে ভারত থেকে নিয়মিতভাবে আমদানি অব্যাহত রাখতে চায় বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে, প্রতিবছর ভারত থেকে ১৫ লাখ টন চাল, ২০ লাখ টন গম, ১০ লাখ টন চিনি, ৬ লাখ টন পেঁয়াজ, ১ লাখ টন আদা ও ৫০ হাজার টন রসুন আমদানির কোটা চেয়েছে বাংলাদেশ।
ভারতের পক্ষ থেকে এসব পণ্যে বাংলাদেশকে কোটা দেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দেওয়া হলেও— প্রতিবেশী দেশটি নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে গম, চাল, চিনি, পেঁয়াজ ও আলু রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
প্রতিবছর গড়ে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ। এছাড়া, ২০২২ সালের মে মাসে রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আগে বাংলাদেশের মোট গমের চাহিদার ৬২ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি হয়েছে।
গত অর্থবছর বাংলাদেশ ৫১৩ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করেছে বাংলাদেশ, এর ৬৩.৮ শতাংশই আমদানি হয়েছে ভারত থেকে।
২০১৯ সালে ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকা অতিক্রম করে। তখন থেকে কোনো পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আগে বাংলাদেশকে বার্তা দেওয়ার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী। তবে ভারত সে অনুরোধ রাখেনি।
রমজানের আগে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে শনিবার মন্ত্রীদের নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য অর্থ, বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ চালসহ খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও– গত ৭ জানুয়ারির ভোটের পর প্রথম সপ্তাহেই চালের দাম পাইকারি ও খুচড়া বাজারে প্রতি কেজিতে অন্তত ৫ টাকা বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা এজন্য সিন্ডিকেটের দৌড়াত্ম্য এবং সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেছেন, যা সব পর্যায়েই দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
রমজানে পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম নির্দেশনা উল্লেখ করে রবিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসান ইসলাম টিটু বলেছেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে জাহাজ ভাড়া (ফ্রেইট চার্জ) বাড়ছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজার দরে উত্থান ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণেও পণ্যমূল্য বাড়ছে। আমরা পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। এখানে ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো ভয়-ভীতি নেই। তবে কেউ যদি মজুতদারি করে, বা কৃত্রিমভাবে পণ্যমূল্য বাড়াতে চেষ্টা করে– তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
‘গুটিকয় বড় ব্যবসায়ী, বড় করপোরেটগুলো ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে। এসব বিগ ফিশদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হবে’- জানান তিনি।
‘পণ্যমূল্য কমাতে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত, এবং আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখাসহ সরবরাহের সময় কমিয়ে আনা হবে। ভোক্তাদের স্বস্তি দেওয়াই হবে আমাদের মূল কাজ। অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্ত হাতে দমন করা হবে। বাংলাদেশে কোন সিন্ডিকেট থাকবে না’- যোগ করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী।
সিন্ডিকেট বন্ধ ও কারসাজিকারীদের রুখতে সরকারের হাতে পর্যাপ্ত উপায় আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বড় প্রডিউসার (উৎপাদক) ও বড় বাজারগুলো পরিদর্শনে যাব। তাদের কোন সমস্যা থাকলে তাও সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে চিঠি দেওয়া হতো। ‘এখন থেকে চিঠির সঙ্গে হয় বাণিজ্য সচিব, না হয় আমি স্বশরীরে যাব এবং হাতে হাতে কাজ করিয়ে আনব।’
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অর্থমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছেন উল্লেখ করে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সামনে আমি অর্থমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের সহায়তা চেয়েছি। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় নিয়ে একটি টিম গঠন করা হবে’- বলেও জানান তিনি।
রবিবার, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর প্রথম কর্মদিবসে তিনি জানান, বিভিন্ন পণ্যমূল্যকে ভিত্তি হিসেবে ধরে এর সঙ্গে প্রতিদিনের বাজারদরের তুলনা করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে নিজের সফলতা-ব্যর্থতা নিজেই বিশ্লেষণ করবেন প্রতিমন্ত্রী।
এছাড়া, আগামী জুনের মধ্যে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অনুমতি দেবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এই এক্সচেঞ্জ চালু হলে, পণ্যের গুণগত মান ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করেন তিনি।
এদিকে, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে মুদ্রানীতি খাতের বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বৈঠকের একটি সূত্র বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে।
গভর্নরকে উদ্ধৃত করে সূত্রটি জানায়, তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির ইকোনমিক সাইড নিয়ন্ত্রণে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেঁছনে যে নন-ইকোনমিক সাইড রয়েছে, সেগুলো অনেক বেশি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নন-ইকোনমিক সাইডে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হতে হবে। কারণ, নন-ইকোনমিক সাইডটা অনেক বেশি প্রবলেম হয়ে উঠেছে, ইনফ্লেশনের (মূল্যস্ফীতির) প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘নন-ইকোনমিক সাইড’ বলতে বাজার কারসাজিকে বুঝিয়েছেন গভর্নর। কারসাজি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর সক্রিয়তা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
‘মূল্যস্ফীতি যদি একবার বেড়ে যায়, তাহলেও কমে কিন্তু আস্তে আস্তে। আশা করছি, এটা কমে আসবে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে এ না আসা পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, আমরা সেসব পদক্ষেপ নেব’- অর্থমন্ত্রীকে জানান গভর্নর।