ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: গাজায় চলমান যুদ্ধ তৃতীয় মাসে গড়িয়েছে। ফলে উপত্যকাটিতে তৈরি হয়েছে তীব্র মানবিক সংকট। কেননা ইসরায়েলের চলমান নির্বিচারে করা বোমা হামলায় বেশিরভাগ অঞ্চলেই পৌঁছাতে পারছে না ত্রাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাক।
ফলে গাজাবাসীদের একটি রুটির জন্যও যেন হাহাকার করতে হচ্ছে। পরিবারগুলো খাদ্যের জন্য বাধ্য হতে জবাই করছে গাধা।
হামাসকে ধ্বংসের কথা বলে পুরো গাজা উপত্যকাকেই যেন ইসরায়েল ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে। এদিকে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিরোধ। এমতাবস্থায় ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে খাবারসহ মৌলিক চাহিদা পৌঁছানো যেন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘের হিউমেনটেরিয়ান অফিস ওসিএইচএ গতকাল (বৃহস্পতিবার) জানায়, মিশরের সীমান্তের কাছে রাফাহ এলাকায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। যেখানে গাজার প্রায় ২৩ লাখ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক আশ্রয় নিয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, “গাজা উপত্যকার বাকি অংশের প্রধান সড়কে সংঘর্ষের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অনেকাংশে বন্ধ হয়ে গেছে।”
চলমান যুদ্ধে ভুক্তভোগী তেমনি একজন গাজাবাসী আবদেল-আজিজ মোহাম্মদ। ৫৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি নিজের পরিবারসহ উপত্যকাটির আরও দক্ষিণাঞ্চলে এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেণ। সবমিলিয়ে ঐ বাড়িতেই শরণার্থীর সংখ্যা ৩৯ জন।
টেলিফোনে এক সাক্ষাৎকারে আজিজ মোহাম্মদ রয়টার্সকে বলেন, “আমার একটা বড় বাড়ি ছিল, সেখানে বিদ্যুৎ ছিল। খাবারে ভর্তি দুটো ফ্রিজ ও পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ছিল। আর এখন যুদ্ধের দুই মাস পর আমি রুটি ভিক্ষা করছি।”
আজিজ মোহাম্মদ আরও বলেন, “এটা যেন এক অনাহারের যুদ্ধ। ইসরায়েল আমাদের বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়িঘর ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করেছে। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেন আমরা সেখানে তাদের বোমার আঘাতে কিংবা ক্ষুধায় মারা যাই।”
জাতিসংঘের এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস (ইউএনআরডব্লিউএ) এর প্রধান জানান, গাজার ক্ষুধার্ত মানুষেরা সাহায্যের ট্রাক থামিয়ে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন।
গাজার উত্তরাঞ্চল যুদ্ধের প্রথম পর্বে ইসরায়েলের হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। যার সময়কাল ছিল হামাসের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সময় (২৪ নভেম্বর) পর্যন্ত। এরপর অঞ্চলটিতে কিছু ত্রাণ প্রবেশ করলেও গত ১ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে খুব কমই সাহায্য পৌঁছেছে।
উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়া এলাকা থেকে ইউসুফ ফারেস নামের একজন সাংবাদিক বলেন, “ময়দার মতো প্রধান খাদ্যসামগ্রী পাওয়াই যেন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের আগের সময়ের তুলনায় এগুলোর দাম ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি।”
ইউসুফ ফারেস বলেন, “আজ সকালে আমি একটি রুটি কিনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি সেটি কিনতে পারিনি। বাজারে থাকা অবশিষ্ট খাদ্যের মধ্যে আছে শিশুদের জন্য মিছরি আর শিম; যার দাম আবার ৫০ গুণ বেড়েছে।”
ঐ সাংবাদিক বলেন, “আমি এমন একজনকে দেখেছি যে তার পরিবারের সদস্যদের খাবারের ব্যবস্থা করতে একটি গাধা জবাই করেছে।”
এদিকে সমস্ত ত্রাণবাহী ট্রাক মিশরের সাথে রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজায় প্রবেশ করছে। তবে গত ২০ অক্টোবর থেকে চালু হওয়া এই কার্যক্রমে প্রথমে সেগুলো ইসরায়েলি বাহিনী তদারকি করে দেখছে।
বুধবার থেকে ইসরায়েল ও গাজার মাঝে থাকা কেরেম শালোম ক্রসিংয়েও অতিরিক্ত তদারকি শুরু করেছে তেল আবিব। আর ত্রাণের ব্যবস্থাপনায় থাকা কর্মকর্তারা পথে পথে তৈরি করা এমন বাধাগুলি কমানোর দাবি করেছেন।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানান, গত বুধবার গাজায় ১৫২ টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে; যা আগের দিনেও প্রায় ১০০ টি ছিল। তবে এগুলো গাজায় উদ্ভূত মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলার প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা রাফার পরিবর্তে কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে সরাসরি গাজায় ট্রাক প্রবেশ করতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটির বিশাল সংখ্যক মানুষ আরও সহজে ত্রাণের আওতায় আসবে।
মূলত গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার প্রায় ১২০০ জন নিহত হয়েছিল। এরপরেই তেল আবিবের পক্ষ থেকে শুরু হয় নির্বিচারে বোমা হামলা।
এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ১৮ হাজার ৬০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
একইসাথে গাজা উপত্যকার প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় ৮০ ভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যারা বাধ্য হয়ে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন।
তেল আবিব গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর এতটা নির্মমভাবে বিমান হামলা চালাচ্ছে যে, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এটিকে ‘পৃথিবীর মধ্যে জাহান্নাম’ বলে অভিহিত করেছেন। একইসাথে উপত্যকাটিতে খাদ্য, জ্বালানি, পানি ও বিদ্যুতের প্রবেশাধিকারও কঠোরভাবে সীমিত করেছে দেশটি।