পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
রবিবার, নভেম্বর ২৪, ২০২৪

খসে পড়ছে মার্কিন গণতন্ত্রের মুখোশ

ছাত্রবিক্ষোভে নির্বিচার বলপ্রয়োগ

ছয় দফা নিউজ ডেস্ক:
‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ আমাদের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।’ শুক্রবার বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। বৃহস্পতিবার যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশি নিপীড়নের শিকার হওয়া এক মার্কিন অধ্যাপকের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এই নারী শিক্ষককে মাটিতে উপুর করে ফেলে তার হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরায় পুলিশ। সে দিনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি রুখতে টিয়ার গ্যাসের শেল ও টিজারও ব্যবহার করে মারমুখী পুলিশ। ফিলিস্তিনপন্থি কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বড় আকারের গ্রেফতার অভিযানও চালিয়েছে দেশটির পুলিশ।

চীনের গ্লোবাল টাইমসের শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসের বিক্ষোভে পুলিশি বলপ্রয়োগ মার্কিন গণতন্ত্রের ভণ্ডামোকে প্রকাশ্যে এনেছে। একইভাবে তেহরানভিত্তিক সাংবাদিক শাহরুখ শাহ মনে করছেন, এই ছাত্র বিক্ষোভ মার্কিন গণতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। এদিকে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিক্ষোভের অধিকার সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতর ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

‘আমি একজন অধ্যাপক’ : সিএনএনের সাংবাদিকদের রেকর্ড করা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ চলার সময় পুলিশ কর্মকর্তারা এক বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীকে মাটিতে ফেলে জোরজবরদস্তি গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। সে সময় ওই শিক্ষার্থীকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে সেদিকে এগিয়ে যান অধ্যাপক ক্যারোলাইন ফলিন। তিনি পুলিশ সদস্যদের ওই শিক্ষার্থীকে ‘ছেড়ে দিতে’ বলতে থাকলে পাশ থেকে আরেক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে ল্যাং দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। আরও এক পুলিশ কর্মকর্তা এতে যোগ দিয়ে ফলিনকে মাটিতে ঠেসে ধরতে সহকর্মীকে সাহায্য করেন। দুই পুলিশ কর্মকর্তা অধ্যাপক ফলিনের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেন। এ সময় ফলিন বারবার বলছিলেন, ‘আমি একজন অধ্যাপক।’ এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

নির্বিচার বলপ্রয়োগ ও গ্রেফতার : যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই ছাত্রবিক্ষোভের সূচনা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও তা শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদ আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে আছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার ভোররাত পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেস, বোস্টন ও টেক্সাসের অস্টিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে দুই শতাধিক প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে ফের প্রতিবাদ করে।

ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে ছিলেন আরেক অধ্যাপক নোয়েলে ম্যাকাফি। বৃহস্পতিবার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম ডেমোক্র্যাসি নাউকে বলেন, আচমকাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়েছিল পুলিশ। টিজার ও টিয়ার গ্যাস ব্যবহারের পাশাপাশি তারা রাবার বুলেটও ছুড়েছে।

বলপ্রয়োগের পাশাপাশি চলছে নির্বিচার গ্রেফতার। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকশ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারপরও বিক্ষোভ থামছে না।

ব্লিঙ্কেন বলছেন, এটাই গণতন্ত্র : চীনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একদিনের বৈঠকের পর বেইজিংয়ে বক্তৃতাকালে শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন ছাত্রবিক্ষোভ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘এই ধরনের বিক্ষোভ আমাদের গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নাগরিকরা যেকোনো সময় তাদের মতামত, উদ্বেগ এবং ক্রোধ প্রকাশ করতে পারে, যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চীন।’ ব্লিনকেন বলেন, ‘আমি মনে করি, এই ধরনের বিক্ষোভ একটি দেশের শক্তিকে প্রতিফলিত করে।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘প্রতিবাদকারীরা হামাসের নিন্দা করেনি, যারা গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে অভূতপূর্ব হামলা চালিয়েছিল।’ তবে বিক্ষোভ দমনে ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা, নির্বিচার বলপ্রয়োগ, শয়ে শয়ে গ্রেফতারের প্রসঙ্গ পুরোপুরিই এড়িয়ে গেছেন তিনি।

কী বলছেন বিশ্লেষকরা : যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী, ধর্মের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে হবে। এই সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো জাতীয় ধর্ম প্রতিষ্ঠা কিংবা কারও ধর্মীয় স্বাধীনতায় আঘাত দেওয়া, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার হরণ কিংবা বাকস্বাধীনতা হরণের কোনো সুযোগ নেই। সাংবাদিক শাহরুখ শাহ তেহরান টাইমসে লিখেছেন, ‘নিঃসন্দেহে, কলেজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার মার্কিন সংবিধানের লঙ্ঘন। কেননা তারা তাদের কণ্ঠস্বর শোনাতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেছে। ইসরাইলকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি সহিংসতা থেকে প্রমাণ হয়েছে, ইসরাইলি গণহত্যাকে মদদ দেওয়ার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র তাদের গণতন্ত্রও ত্যাগ করতে পারে। কলেজ ক্যাম্পাসে গণগ্রেফতার আসলে ফাঁস করে দিয়েছে, মার্কিন গণতন্ত্রের মুখোশের পেছনে আসলে কী রয়েছে।

বাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর আইন প্রয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ পরিস্থিতি শান্ত করার পরিবর্তে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশ্লেষকরা মার্কিন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের এই ভণ্ডামিকে জোর দিয়ে তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থনের বিপরীতে রয়েছে মৌলিক মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের অনুভূতি এবং বিশ্বাস। এই বৈপরীত্যের স্বাভাবিক ফল যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ।

চায়নিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর গবেষণা ফেলো লু জিয়াং গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন একটি দ্বিধায় রয়েছে। কারণ ইসরাইল সম্পর্কিত নীতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। আবার সমর্থন অব্যাহত রাখার অর্থ আরও ব্যাপক এবং আরও সহিংস বিক্ষোভের বড় ধরনের সম্ভাবনা।

জাতিসংঘ ও এইচআরডব্লিউর নিন্দা : জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে বলেছেন, ‘মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ শিক্ষার্থীর গ্রেফতার এবং বেশ কয়েকটি মামলার কারণে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। বিক্ষোভে পুলিশের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই কঠোর। লরেন্স বলেছেন : ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকারগুলো মৌলিক। প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার রয়েছে এবং তাদের তা করতে বাধা দেওয়া উচিত নয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। ইহুদিবিদ্বেষী ও ইসলাম-ভীতিকর কোনো ঘটনা ঘটলে পৃথকভাবে তার স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিবাদকে ‘ইহুদি বিদ্বেষের’ তমকা দেওয়া যাবে না।

তথ্যসূত্রঃসময়ের আলো

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ