ছয় দফা নিউজ ডেস্ক:
দেশের বহু সূচক নেতিবাচক হলেও কৃষিঋণ বিতরণ বাড়ছে। এর বিপরীতে আদায়ের হারও সন্তোষজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৫ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫ হাজার ২৫১ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কৃষকরা কখনও ঋণ জালিয়াতি করেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে তারা মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়েন। কিন্তু দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মতো ঋণখেলাপির প্রবণতা তাদের মধ্যে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বিতরণ করা মোট কৃষিঋণের স্থিতি ৫৩ হাজার ২৩০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৮৭ কোটি টাকা বকেয়া। সার্বিকভাবে কৃষিতে খেলাপি ঋণের হার ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৩ হাজার ৯২৪ কোটি।
এই দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। জুলাই ও আগস্টে মোট ৮৫৩ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। ৪৮৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। আলোচ্য দুই মাসে ৩৯৭ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এ ছাড়াও ইসলামী ব্যাংক বিতরণ করেছে ৩৫৩ কোটি এবং ব্র্যাক ব্যাংক বিতরণ করেছে ২২৩ কোটি টাকার কৃষিঋণ।
দেশের ব্যাংকগুলো থেকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষকরা ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর বিপরীতে তারা পরিশোধ করেছেন ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর আগেও কৃষকরা ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের চেয়ে বেশি পরিশোধ করেছেন। এমনকি কভিড-১৯-এর প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের চেয়ে আদায় হয়েছে বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। ওই বছর কৃষকরা ২৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করেছেন।
দেশের কৃষকদের দেওয়া ঋণ সুবিধার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে এনজিওর মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে নেওয়া ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে। প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছার সক্ষমতাই দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে। এনজিওগুলো ব্যাংক থেকে ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকদের মধ্যে দ্বিগুণ-তিনগুণ সুদে বিতরণ করছে।
নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করে নীতিমালা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কম সুদে কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছাতে এবার ক্ষুদ্র ঋণদাতা সংস্থার (এমএফআই) ওপর বেসরকারি ব্যাংকের নির্ভরশীলতা আরও কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর এ জন্য ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্তত ৫০ শতাংশ কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এতদিন ছিল ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষিঋণের কত অংশ কোন খাতে দিতে হবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক। কিন্তু এ বছর পুরো ব্যাংক খাতের জন্য কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করেছে দেশের ব্যাংকগুলো। কিছু কিছু ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি বিতরণ করেছে। আবার কিছু ব্যাংক কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রায় অর্জন করতে পারেনি। এ রকম ব্যর্থ ব্যাংকের সংখ্যা আটটি।
নতুন অর্থবছরের জন্য প্রণীত কৃষিঋণ নীতিমালায় বলা হয়, ভবনের ছাদে বিভিন্ন কৃষিকাজ করা একটি নতুন ধারণা। বর্তমানে যা শহরাঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত বাড়ির ছাদে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ফুল, ফল ও শাকসবজির যে বাগান গড়ে তোলা হয় তা ছাদবাগান হিসেবে পরিচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, যাদের চাষের জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই, কিন্তু নিজ হাতে কৃষিকাজ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য ছাদকৃষি একটি উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা। শহরাঞ্চলে বাড়ির ছাদে বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্যের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব। পাশাপাশি ছাদকৃষি পরিবেশ রক্ষা ও বায়ুদূষণ প্রতিরোধেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাদকৃষিতে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এ খাতের ঋণ দেওয়ার জন্য গ্রাহকের চাহিদা যাচাইবাছাই করে ব্যাংক কত টাকা ঋণ দেবে এবং কীভাবে আদায় করবে তা নির্ধারণ করবে।
এবার কৃষি ও পল্লীঋণের চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩০ কোটি টাকা পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংক ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, কৃষি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ) ও ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হতে হবে। আগে তা ছিল ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া মৎস্য খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ ও প্রাণিসম্পদ খাতে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে বলা হয়।