পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

জাত ব্যবসার টানে ওদের যাযাবর জীবন যাত্রা

কায়সার রহমান রোমেল:
পূর্বপুরুষেরা ছিলেন যাযাবর। তারা জীবিকার সন্ধানে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াতেন। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার এ সময়ও কিছু কিছু মানুষ যাযাবর জীবন কাটাচ্ছে। আর এদের এই ছোট ছোট জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায় বলে পরিচিত। কালো প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে ছোট তাঁবুর চালে লাগানো হয়েছে সোলার প্যানেল। তা দিয়ে রাতে বাতি জ্বলে। ছোট ছোট পাখা ঘোরে। এ চিত্র একটি বেদেপল্লির। গাইবান্ধা সদরের তুলশীঘাট হ্যালিপ্যাডের খোলা চত্বরে যাযাবর সম্প্রদায়ের প্রায় ১০টি বেদে পরিবার তাঁবু করে থাকছে পনের দিন ধরে।

যাযাবরদের মতো জীবনধারা হলেও বেদেদের রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ ও সংস্কৃতি, রয়েছে নিজস্ব জীবনবোধ ও স্বকীয়তা। বেদেরা গোত্রকে বলে জাত। মূলত পেশার ওপর ভিত্তি করেই এসব গোত্রের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- যারা সাপ খেলা দেখায় এবং সাপ কেনাবেচা করে তারা সাপুড়ে, যারা ঝাড়ফুঁক করে তারা মিশ্চিয়ারি, যারা জাদু দেখায় তারা বাজিগর বা মাদারি, যারা শারীরিক কসরত দেখায় তারা চামরিয়া, যারা কাচের চুড়ি ও মালা বিক্রি করে তারা সান্দার এবং যারা হাঁড়িপাতিলসহ সাংসারিক জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা সওদাগর নামের গোত্রভুক্ত। তাবিজ-কবজ বিক্রি করে ধবাইলা গোত্রের বেদেরা। যারা মাছ ধরে তারা মানতা। এ ধরনের আরও কয়েকটি গোত্র রয়েছে, যারা বিভিন্ন নামে পরিচিত।

গাইবান্ধায় অবস্থান নেয়া যাযাবর সম্প্রদায়টি দীর্ঘকাল যাবৎ নিজস্ব ঐতিহ্য আর জাত ব্যবসাকে লালন করে অব্যাহত রেখেছে তাদের জীবন-জীবিকা। এই যাযাবর পরিবারগুলোর আদি নিবাস ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কাশিপুর গ্রামে। ওখানে তাদের নিজস্ব বসতবাড়ি এবং আত্মীয়-স্বজন থাকলেও তারা সারাদেশ ঘুরে ঘুরে এভাবে অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলে তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে। কোথাও বসতি গেড়ে ওরা এক সপ্তাহ থেকে দু’সপ্তাহের বেশী অবস্থান করে না। এভাবেই চলে ওদের যাযাবর জীবন যাত্রা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট ছোট বাঁশের খুঁটি পুঁতে দু’পাশে খোলা পলিথিন দিয়ে মোড়ানো অস্থায়ী ছোট ছোট ডেরা। এসব ডেরাতেই অবস্থান করছে ৭টি পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ২৩ জন মানুষ। যাযাবরদের এই দলের সর্দার আব্দুল মান্নান। তার ডেরায় রয়েছে সৌর বিদ্যুৎচালিত ফ্যান ও লাইট। তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, গাইবান্ধায় তাদের অবস্থান ১৫ দিন। তারপর তারা চলে যাবে অন্য কোথাও। তিনি জানালেন, তারা ট্রেনে, বাসে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় যায়। ওইসব এলাকায় এভাবে অস্থায়ী বসতি গেড়ে তারা সাপ, বানর, বেজির খেলা দেখায় এবং দাঁতের পোকা নিধন, বাতের ব্যথা, সাপের বিষ নামানোসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের তাবিজ কবজ বিক্রি করে থাকে। এগুলোই তাদের আদি পেশা। যার উপর নির্ভর করে চলে তাদের সংসার।

সাধারণত পুরুষ এবং শিশুরা ডেরায় অবস্থান করে আর নারীরা ডেরা সংলগ্ন অস্থায়ী চুলায় রান্নাবান্না সেরে ঝোলা কাঁধে আর বেতের ধামা মাথায় করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে খেলা দেখায় এবং ওই সমস্ত তাবিজ কবজ বিক্রি করে। আবার নির্ধারিত সময় বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে তারা ডেরায় ফিরে আসে। দিনের বেলাতেই রান্নাবান্না সেরে তারা সন্ধ্যার সাথে সাথেই ডেরায় অবস্থান নেয়। এভাবেই চলে যাযাবর সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন। বংশ পরম্পরায় তাদের সন্তানেরা এই পেশা আঁকড়ে থাকে।

এদের মধ্যে একটি অদ্ভুত নিয়ম চালু রয়েছে। দলের কোন নারী যদি অসুস্থ হয় তবে সেদিন তার সেবায় সব নারীরা ডেরায় অবস্থান করবে, আর পুরুষরা যাবে কাজে। এছাড়া মূলত: নারীরাই ঘুরে ঘুরে তাদের পেশায় নিয়োজিত থাকে। রাত ৮টার পরে সর্দারের অনুমতি ছাড়া কেউ ডেরার বাইরে অবস্থান করতে পারে না। প্রকৃত পক্ষে এই সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকা পরিচালিত হয় মাতৃতান্ত্রিক নিয়মে। জানা গেছে, এই সম্প্রদায়ের বয়স্ক মানুষ এবং বিবাহযোগ্য যুবক-যুবতীরা সাধারণত বাড়িতেই অবস্থান করে। তাদের প্রথা অনুযায়ী সম্প্রদায়ের মাতব্বরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি কোরবানী ঈদের পর থেকে পরবর্তী কোরবানী ঈদ পর্যন্ত তার নির্ধারিত একটি করে দল বছরজুড়ে এভাবে ঘুরে ঘুরে অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলে যাযাবর জীবনযাপন করে আবার ফিরে আসে নিজ নিবাস কালীগঞ্জ উপজেলার কাশিপুর গ্রামে।

কথা হয় কয়েকটি বেদে পরিবারের সঙ্গে। বেদেপল্লির অনেকেই ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে চান যাযাবর জীবনের অবসান। কিন্তু জাত ব্যবসার টানে আবার তাঁরা ছুটে চলেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এভাবেই চলছে তাঁদের জীবন। চলে যাযাবর জীবন যাত্রা।

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ