পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

রঙিন পাখায় স্বপ্নবুনন

কায়সার রহমান রোমেল:
কথায় বলে, ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। ঠিক যেন তাই,- রান্নাবান্না চলছে, পাশাপাশি হাতপাখা বানানো হচ্ছে। আঙিনায় বসে বিশ্রামের সময় গল্প করতে করতেও কাজ করে চলেছেন তারা। অলস সময় না কাটিয়ে যখনই সময় পাচ্ছেন, বসে পড়ছেন পাখা তৈরির কাজে। ১০ বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা- সবাই মগ্ন এ কাজে। বৈশাখের সকালে গৃহস্থালিতে প্রথম ঢেউ বয়ে যেতে-না যেতেই আঙিনায় বসে যান তারা। রঙিন সুতায় রঙিন পাখায় এ যেন স্বপ্নবুনন।

গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে জামালপুর ইউনিয়নের বুজরুক রসুলপুর গ্রামের খামারপাড়া এবং রসুলপুর ইউনিয়নের আরাজি ছান্দিয়াপুর গ্রাম। এ দুই গ্রামের দেড়শরও বেশি পরিবার বাঁশের চাকের ভেতরে নানা রঙের সুতা দিয়ে তৈরি করে এ হাতপাখা। তাই দুই গ্রামই এখন মানুষের মুখে মুখে পরিচিত ‘পাখার গ্রাম’ নামে।

গ্রামের পুরুষরা কৃষি বা অন্য পেশায় যুক্ত থাকলেও পাখার হাতল, ডাঁটি, চাক তৈরিসহ বাঁশের কাজটুকু তারাই করেন। তবে পাখা তৈরির মূল কাজটিই করেন নারীরা। পাখার গ্রামে ঢুকলে তা-ই চোখে পড়বে এখানে-সেখানে, গাছের নিচে, পুকুরপাড়ে দুই-তিন জন একসঙ্গে বসে গেছেন সুই-সুতা আর চাক নিয়ে। সোমেনা বেগম, মরিয়ম বিবি, হাসিনা বেগম ও মাজেদা খাতুনের মতো অনেকেই পাখা বুনে চলেছেন। কোনো প্রশিক্ষণ নেই, কাজ করতে করতেই শিখে নিচ্ছেন পাখা বানানো।

পাখা কারিগর সোমেনা বেগম বলেন, চৈত্র থেকে আশ্বিন পর্যন্ত চলে পাখার বেচাকেনা। দুই গ্রামের প্রায় ৪০০ পরিবারের মধ্যে দেড় শতাধিক জড়িয়ে আছে এর পেশায়। এসব পরিবারের নারীরা প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার পাখা তৈরি করছেন। পাখা তৈরির পর সেগুলো কেউ কেউ গ্রামেই বিক্রি করেন, কেউ আবার তুলে দেন পাইকারের হাতে। এ দুই গ্রামের পাখা গাইবান্ধা ছাড়িয়ে চলে যায় জামালপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে।

কথা হয় গৃহবধূ মাজেদা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তার স্বামী মাহে আলম কৃষিশ্রমিক ছিলেন। আর তিনি করতেন মানুষের বাড়িতে কাজকর্ম। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। কিন্তু ১০ বছর আগে তিনি হাতপাখা তৈরি শুরুর পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। এখন এক ছেলেকে বগুড়া শহরে রেখে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি হিসেবে গয়না গড়ছেন। কিছু আবাদি জমি নিয়েছেন, আর বাড়িতে তুলেছেন দুটি টিনের ঘর। মাহে আলমও দিনমজুরি ছেড়ে এখন পাখা বিক্রির ব্যবসা করেন। স্বামী আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালোই আছেন তিনি।

কারিগর হাসিনা বেগম জানান, পাখার জন্য সুতা আসে পাশের উপজেলা গোবিন্দগঞ্জ থেকে। এখন মোবাইল ফোনেই জানিয়ে দেন চাহিদার কথা। দোকানি বাড়িতেই সুতা পৌঁছে দেয় ৩০০ টাকা কেজি দরে। এক কেজি সুতা দিয়ে বানানো যায় ২৫ থেকে ৩০টি পাখা। প্রতিটি পাখা তৈরি করতে ১০ টাকার সুতা, ২ টাকার বাঁশের হাতল, ৩ টাকার বাঁশের চাক, ৩ টাকার সুতা মোড়ানোর কাপড় ও পারিশ্রমিকসহ প্রায় ২৫ টাকা খরচ করতে হয়। এর মধ্যে ৩০-৩৫ টাকার একচাকার পাখা যেমন আছে, তেমনি আছে ৭০-৭৫ টাকা দামের দো-চাকা পাখাও। একেকজন দিনে ৭ থেকে ১০টা পাখা বুনতে পারেন। পাইকাররা এসে বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যায় পাখা। বছরের সাত-আট মাস চলে পাখা তৈরির কাজ। তবে ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত এর চাহিদা থাকে বেশি।

খামারপাড়া গ্রামে পাখা তৈরির পথিকৃৎ মরিয়ম বিবি জানান, শীতকালে তিন মাস পাখা তৈরির কাজ বন্ধ থাকে। ওই তিন মাস সুতা, বাঁশ, কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে মজুদ রাখেন তারা। তিনি বলেন, পাখা তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। ঋণ নিয়ে কাজ করতে হয়। পাখা বিক্রি হলে সেই ঋণ সুদ-আসলে শোধ করতে হয়।

পাখার কারিগরদের দাবি, বিনা শর্তে ঋণ দিয়ে কিংবা শিল্পগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে হাতপাখা ব্যবহারের পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব।

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ