পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
রবিবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪

মুড়ির শব্দে মিশে আছে জীবনের ছন্দ

গাইবান্ধার মুড়ির গ্রাম

কায়সার রহমান রোমেল:
গাইবান্ধা সদর উপজেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বালুয়া-নাকাইহাট-গোবিন্দগঞ্জ সড়কে গোপালপুর বাজার। বাজার পার হয়ে ডানে মাটির আঁকাবাঁকা পথ। দু’পাশে বিস্তৃত মাঠ মাড়িয়ে সরু পথের সবুজ গ্রাম। সবুজে ঘেরা সেই গ্রামের মধ্যে ছোট ছোট উঠোনে একেকটি বাড়ি। আর সে বাড়ির উঠোনের কোণে বসতঘরের পাশেই ছোট আরেকটি ঘর। রান্নাঘরের মতোই, কিন্তু ঠিক রান্নাঘরও নয়। বেড়াবিহীন ঘরগুলোতে চুলা আছে সারি সারি। সে চুলায় রান্না হয় ঠিকই, তবে তা ভাত, মাছ বা মাংস নয়, বালুর ভেতরে রান্না হয় চাল। আর তা থেকে তৈরি হয় মুড়ি। মুড়ি ফোটার শব্দে যেন মিশে রয়েছে ওদের জীবনের ছন্দ।

গাইবান্ধা সদরের রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জগৎরায় গোপালপুর গ্রাম। গ্রামের মানুষরা কেউ লাকড়ি কুড়াচ্ছেন, কেউ মুড়ির জন্য শুকোচ্ছে চাল। কেউবা মাটির খোলায় চাল গরম করছে। গরম বালুর স্পর্শে তা মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি। এই গ্রামটিতে শতাধিক পরিবারের পেশা মুড়ি তৈরি। ঐতিহ্যগতভাবেই এই গ্রামের বাসিন্দারা কয়েক পুরুষ ধরে দেশীয় পদ্ধতিতে মুড়ি তৈরি করে আসছে। এ যেন মুড়িরই গ্রাম। সারাবছর খুব একটা খোঁজখবর না থাকলেও রোজার মাসে মুড়ি ছাড়া চলেই না। শহর থেকে গ্রাম, ফুটপাথ থেকে অভিজাত হোটেলÑ সব জায়গায় ইফতারির তালিকার অপরিহার্য পণ্য এই মুড়ি।

এক চুলায় মাটির হাঁড়িতে চলে শুকনো বালু গরম করা, অন্যপাশে অপর চুলায় চলে হালকা করে চাল ভাজার কাজ। নারিকেল পাতার শলা দিয়ে নাড়াচাড়ার পর ভাজা চাল হালকা হলদে-বাদামি বর্ণের হলে উত্তপ্ত বালুর ওপর ঢেলে দেওয়া হয়। এবার মাটির হাঁড়ি নাড়াচাড়া দিতেই মট মট শব্দে ফুটে ওঠে ধোঁয়া ওড়া সাদা মুড়ি।

এ সময়ও ঘর লাগোয়া উঠানো চলতে থাকে ধান শুকানো। অন্যপাশে চলে ধান সেদ্ধ করা। সেদ্ধ সে ধান আবার মাটির চাড়িতে করে ভিজিয়ে রাখা হয় উঠোনের পাশেই। মুড়ি তৈরির এ কৌশল গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কাছে খুব সাধারণ হলেও শহরের মানুষের কাছে তা ঐতিহ্যের মিশেলে গ্রামীণ পরিবেশে শৈল্পিক এক পেশা।

জীবন-জীবিকার তাগিদে এই গ্রামের লোকজন মুড়ি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নারীরা মুড়ি তৈরির জন্য চাল শুকানো থেকে ভাজার কাজ করে থাকে। আর পুরুষরা সেসব বিক্রি করতে নিয়ে যায় বাজারে। সনাতন পদ্ধতিতে হাতে মুড়ি ভেজে গ্রামের প্রায় ১০০টি পরিবার সংসার চালাচ্ছে। হাতে মুড়ি ভেজে বিক্রি করা গ্রামের অনেক নারী-পুরুষের জীবিকা হয়ে ওঠায় গ্রামটি ‘মুড়ির গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।


দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি মুড়ি ভাজা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন মিনতি রানী। জগৎরায় গোপালপুর গ্রামের বৈরাগীপাড়ার এই নারী জানান, ‘সারাবছরই এই গ্রামে মুড়ি ভাজার কাজ চলে। তবে রমজান মাস এলে চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তাই এ সময় পরিবারের সবাই মিলেই নেমে পড়তে হয় এ কাজে।’

মুড়ির কারিগর আরেক নারী গীতা রানী জানান, ‘রমজানে হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা অনেক। কিন্তু পুঁজির অভাবে ঠিকমতো মুড়ি সরবরাহ করতে পারছি না। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত মুড়ি ভেজে বিকালে বাড়ির উঠোনে পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। এ টাকা দিয়েই চলে সংসারের খরচ। ছেলেমেয়েরাও স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে।’

গাইবান্ধার মুড়ির গ্রামে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কথাও জানান বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বিপ্লব হোসেন। বিপ্লব বলেন, ‘গ্রামে যাদের পুঁজি নেই, তারা অনেকে মহাজনদের সঙ্গে মুড়ি ভেজে দেওয়ার চুক্তি নেন। এ ক্ষেত্রে মহাজনরা মুড়ি কারিগরদের অগ্রিম টাকা দেন। প্রতিকেজি মুড়ি ভাজার জন্য তারা পান ৫০ টাকা। আর মহাজনরা সেসব মুড়ি বিক্রি করেন প্রতিকেজি ৭০-৮০ টাকা।’

মুড়ির কারবারি নজরুল ইসলাম সনাতনী প্রক্রিয়ায় মুড়ি ভাজা সম্পর্কে বলেন, ‘মুড়ির চাল পানিতে ধুয়ে ধুলাবালি পরিষ্কার করতে হয়। এরপর পরিমাণমতো লবণ মিশিয়ে রোদে শুকানোর পর ভাজতে হয়। গরম বালুর ভেতর চাল ঢেলে নাড়তে থাকলে চাল ফুটে মুড়ি তৈরি হয়। পরে বালু আলাদা করলেই পাওয়া যায় সুস্বাদু মুড়ি। এক মণ ধানে ২২-২৩ কেজি মুড়ি পাওয়া যায়।’

রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের নারী কাউন্সিলর মনিরা আক্তার মনি বলেন, ‘জগৎরায় গোপালপুর গ্রামের মুড়ির কারিগরদের তৈরি মুড়ি জেলার চাহিদা মিটিয়ে তা চলে যায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মুড়ি কারিগরদের এই গ্রামটিকে শিল্পগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারি পুষ্ঠপোষকতায় তাদের সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ ও উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে গাইবান্ধার মুড়ির গ্রামের মুড়ি বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।’

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ