ছয় দফা নিউজ ডেস্ক:
ডেঙ্গু আগামী দিনে আরও ভয়াবহ আকারে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি বলেছেন, ডেঙ্গু এখন জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এর নিয়ন্ত্রণে এখন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নেতৃত্ব দরকার। বড় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন।
শনিবার (২৫ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর মহাখালীতে নিপসমের সভাকক্ষে ‘ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মীরজাদী সেব্রিনা এসব কথা বলেন। এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইপাব)।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন।
অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের পদস্থ কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ববিদ, টিকা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা অংশ নেন। তবে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ঢাকার দুই সিটির কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাণী এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে সামনের বছরগুলোতে রোগটি আরও ব্যাপক আকারে দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৈঠকে এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, গ্রাম পর্যায়ে কী হবে-এটা চিন্তার বিষয়। সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক সচেতনতামূলক কাজ করা হয়েছে। এইডিস ইজিপ্টি নিয়ে অনেক আলোচনা থাকলেও এইডিস অ্যালবোপিকটাস নিয়ে কেউ ভাবছেই না। অথচ ধান গাছ, কলাগাছের পাতা, গাছের কোটর এমনকি কচু গাছের পাতায়ও এইডিস অ্যালবোপিকটাসের লার্ভা হয়।
ডা. মীরজাদী সেব্রিনা করোনাকালের সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, করোনার নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের অনেকেই অংশীদার। আমি মনে করি কোভিডের (নিয়ন্ত্রণের) সাফল্যের পেছনে যে কয়টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল, তার ১ নম্বর হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু আমাদের জন্য জাতীয় সমস্যা। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নেতৃত্ব দেওয়া না হলে সব মন্ত্রণালয়কে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করাটা কঠিন হবে।
অনুষ্ঠভানের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে যত আক্রান্ত হয়েছে, এবার এই নভেম্বরের মধ্যে তার তুলনায় সোয়া গুণ রোগী বেশি হয়ে গেছে। আর ২৩ বছরের চেয়ে এবার প্রায় ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, এবার আক্রান্ত রোগীদের ৬০ ভাগ পুরুষ। কিন্তু ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৫৮ শতাংশ নারী। এবার আক্রান্তদের ৬২ শতাংশের বেশি বয়স ৩০ বছরের এর নিচে। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের ৬৪ ভাগের বয়স ৩০ বছরের বেশি।
ডেঙ্গু বিস্তারের সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক তুলে ধরে মুশতাক হোসেন বলেন, ২০০০ থেকে ২০১০ সালে দেশে গড় তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা ২৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক দশকে তাপমাত্রা দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ডেঙ্গুর রোগ সৃষ্টিকারী এডিস মশার বিস্তারে বড় ভূমিকা রাখে।
ডেঙ্গু পরিবারের খরচের বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসায় গড় খরচ হয়েছে ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। এরমধ্যে সরকারি হাসপাতালে ২২ হাজার ৩৭৯ টাকা এবং বেসরকারিতে ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা। এছাড়াও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠির মোট আয়ের চেয়ে অতিরিক্ত খরচ হয়েছে ৩৯ শতাংশ।
এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিপরীতে নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা খুব অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) কর্মকর্তা এস এম আলমগীর।
তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত কোনো টাস্কফোর্স হয়নি। একটি জরুরি সভা হয়নি। কোনো দেশে ডেঙ্গু শুরু হলে এটি শেষ হয়ে যায় না। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সে জন্য জরুরি সমন্বিত উদ্যোগ নেই। জনসম্পৃক্ততা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে তেমন করে সহযোগিতাও চাওয়া হয়নি। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আমরা সহযোগিতা করতে সব সময় প্রস্তুত।
সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) মো. আখতারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসম্পৃক্ততা সহজ কাজ নয়। নির্বাচনে জনসম্পৃক্ততা সহজ। কোনো কোনো দেশে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে আইনও আছে।
অনুষ্ঠানে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা স্তরের উদ্যোগ দরকার। এটা শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। এটা এখন সারা বছরের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই এর নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও বহুমাত্রিক পদক্ষেপ দরকার।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইপাবের সহসভাপতি ইকবাল কবির। স্বাগত বক্তব্য দেন ইপাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল রেজা চৌধুরী।