পরীক্ষামূলক সম্প্রচার চলছে...
শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪

কেন আফগান আফিমের দাম চড়া এখন বিশ্ববাজারে

ছয় দফা নিউজ ডেস্ক: আফগান আফিমের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই। এক কিলোগ্রাম পপির রস মরফিনের মতো ব্যথানাশক এবং হেরোইনের মতো শক্তিশালী নেশা জাতীয় দ্রব্যের মূল উপাদান। এর বাজার মূল্য প্রায় ৪০৮ ডলার৷ এটি ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ এবং দুই দশকের মধ্যে যা সর্বোচ্চ মূল্য।

তালেবান শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক চাষাবাদের উপর নিষেধাজ্ঞার ফলে পার্বত্য দেশটির সমস্ত অঞ্চলে আফিম পোস্ত উৎপাদনের উপর একটি বড় প্রভাব পড়েছে। এশিয়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দেশটি সম্প্রতি আফিমের বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারী দেশ ছিল।

জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) পর্যালোচনা অনুসারে, আফগানিস্তানের ২০২৩ সালে পপি চাষের জন্য ব্যবহৃত এলাকা ৯৫.৩ শতাংশ কমে ২৩৩,০০০ হেক্টর থেকে ১০,৮০০ হেক্টরে নেমে এসেছে।

গত ১৫ আগস্ট, ২০২১ সালে তালেবানরা কাবুলে প্রবেশ করে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এই ধস দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আরও ব্যাহত করেছে। যা ২০২২ সালের শেষ নাগাদ স্থিতিশীল হয়েছে মনে করা হয়েছিল।

অলাভজনক সংস্থা আফগানিস্তান অ্যানালিস্ট নেটওয়ার্কের সহ-পরিচালক কেট ক্লার্ক বলেন, “এই নিষেধাজ্ঞা লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের রোজগার থেকে বঞ্চিত করেছে।”

২০২২ সালের এপ্রিলে নিষেধাজ্ঞাটি ঘোষণা করা হলেও ভেটোটি একই বছরের রোপণের মৌসুমে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। নিষেধাজ্ঞাটি এমন এক পরিস্থিতিতে দেওয়া হয়েছে যখন কয়েক দশকের সশস্ত্র সংঘাত, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে হাজার হাজার মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছে। একইসাথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তীব্র খরা এবং শীতকালীন তাপমাত্রা হ্রাস দেখা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম বার্ড বলেন, “এটি কৃষকদের এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি উপার্জন থেকে বঞ্চিত করেছে। যার মধ্যে আফিম প্রক্রিয়াকরণ, বাণিজ্য এবং রপ্তানি সংক্রান্ত ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত নয়।”

এমতাবস্থায়, দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক অনুমান মতে, আফগানিস্তানের জিডিপি ২০২১ সালে ২১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে আরও ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অর্থনীতির গতিও পূর্ববর্তী অর্থবছর জুড়েও বেশ দুর্বল ছিল।

একইসাথে তালেবান শাসনের কারণে বৈশ্বিক মানবিক সাহায্য কমতে শুরু করেছে। আর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকার ফলে ২০২৪ সালেও দেশটির এ অবস্থার উন্নতি হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

বার্ডের মতে, “আগের ফলনের কিছু মজুদ থাকায় নিষেধাজ্ঞার অর্থনৈতিক প্রভাব কিছুটা প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলির সেই সুবিধা নেই। ফলে তাদের ভোগান্তি আরও অনেক বেশি। মজুদ ফুরিয়ে গেলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর আরও খারাপ প্রভাব পড়বে।”

১৯৭০ দশকের শেষের দিক থেকে আফগানিস্তানের, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইউএনওডিসি অনুসারে, ২০২২ সালে আফিম দেশটির জাতীয় কৃষি উৎপাদনের মোট মূল্যের এক-তৃতীয়াংশ।

পারিবারিক পর্যায়ে আফিমের বিক্রয় ক্ষেত্রবিশেষে একটি পরিবারের আয়ের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কিছু অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জমিতে এটি চাষ করা হয়। দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের জমির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আফিম পোস্ত উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।

জাতিসংঘের সূত্র মতে, কিছু জেলায়, আফিম চাষের জন্য জমির পরিমাণ আরও বেড়েছে। অন্যদিকে, গমের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যসামগ্রীর চাষ কমেছিল।

ফারাহ, হেলমান্দ, কান্দাহার এবং নানগারহা, অর্থাৎ চারটি প্রদেশকে (এ অঞ্চলের প্রায় ৭৫ শতাংশ জমিতে পোস্ত চাষ হয়) কেন্দ্র করে একটি গবেষণা হয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞার মাঝেও আনুমানিক ৬৮ শতাংশ আবাদযোগ্য জমিতে শস্য রোপণ করা হয়েছে।

জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুসারে, এক হেক্টর জমির গমের মূল্য ৭৭০ ডলার। অপরদিকে এক হেক্টর পপির মূল্য প্রায় ১০ হাজার ডলার।

মাদ্রিদের কমপ্লুটেন্স ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হোসে মিগুয়েল ক্যালভিলোর মতে, “আফগানিস্তানের স্থানীয় কৃষি জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক; আফিম দেশটির আয়ের অন্যতম উৎস।”

লন্ডন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসের প্রকাশিত একটি নিবন্ধে হিউম্যানিটারিয়ান পলিসি গ্রুপের গবেষণা সহযোগী ওরজালা নেমাত বলেন, “তালেবান শাসকদের আফিম নিষিদ্ধের প্রভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেছে। আফগান আফিম ইউরোপে ব্যবহৃত ৯৫ শতাংশ হেরোইন উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।”

ইউএনওডিসি সূত্র মতে, “নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বব্যাপী আফিমের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। এই মুহূর্তে আফিম পোস্তের শীর্ষ উৎপাদক মায়ানমার। অন্যান্য দেশ এই স্বল্প সময়ে এই ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম হবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।”

২০২৩ সালে অন্যান্য ফসলের সাথে আফগানিস্তানে প্রায় ৩৩৩ টন আফিম উৎপন্ন হয়েছে। যা আগের বছরগুলোর তুলনায় ৯৪.৬ শতাংশ কম। এর মধ্যে প্রায় ২৪ থেকে ৩৮ টন রপ্তানি গ্রেডের আধা-সিন্থেটিক আফিম (যার বিশুদ্ধতা ৫০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ)। যা ২০২২ সালের উৎপাদনের তুলনায় ৩৫০ থেকে ৫৮০ টন কম।

ফেন্টানাইলের ব্যাপক চাহিদা

ইউএনওডিসির হিসেব মতে, উৎপাদনে এই ধরনের ঘাটতি খুচরা বাজারে হেরোইনের বিশুদ্ধতা হ্রাস পাবে এবং অন্য কোন দ্রব্য দিয়ে এর ঘাটতি পূরণ করা হবে।

তালেবানদের আফিম সরবরাহ বন্ধ করার এটাই প্রথম ঘটনা নয়। তারা তাদের আগের শাসনামলে (১৯৯৬ থেকে ২০০১) পপি চাষ নিষিদ্ধ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞাটি তাদের বর্তমান নিষেধাজ্ঞার মতোই ছিল। যদিও সেই সময়ে কৃষকদের পর্যাপ্ত মজুদ ছিল, যা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

তবে এই মুহূর্তে কৃষকদের কাছে কী পরিমাণ আফিম পোস্ত এবং অন্যান্য আফিম রয়েছে অজানা। ইউএনওডিসি অনুসারে এবং মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদনগুলোর হিসেবে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা তাদের মজুদ হ্রাস করছে।

ইউএনওডিসি রিপোর্টে বলা হয়েছে, “আফগান আফিমের রপ্তানি কমে যাওয়ায় অন্যান্য অবৈধ কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মেথামফেটামিনের মতো সিন্থেটিক দ্রব্য পাচার বাড়তে পারে।”

তথ্যসূত্রঃটিবিএস

আরো পড়ুন

মতামত দিন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সর্বশেষ সংবাদসমূহ

বিশেষ সংবাদ